Saturday, July 26, 2014

স্বপ্নবিভ্রাট




সারাদিন বুঝি নিজের সাথেই কথা বলতে হবে? কি আদিখ্যেতা! কেন আমার কি বন্ধু বান্ধবদের নির্বাসন হয়েছে, নাকি তারা ইহলীলা সাঙ্গ করেছে? 

     আয়নার সাথে কথা বলাও যা আর নিজের মনে বকাও তাআমি সব আয়না ভেঙেই ফেলব আজদেখি কে আটকায় আমায়

     সন্ধ্যেবেলা বিশ্বম্ভরবাবু এই সব নিজের মনে বলতে বলতে মোড়ের চায়ের দোকানে এসে বসলেন
     "পাঁচু চা দে", বিশ্বম্ভরবাবুর মাথায় খুন চেপে আছে আজ
     কেন হবে রোজ এরকম? তিনি যার কথাই ভাববেন বা পড়বেন বা শুনবেন, সে সেই রাত্রেই কোন না কোন রোগ নিয়ে তাঁর স্বপ্নে এসে হাজির হবেবিশ্বম্ভরবাবু হলেন গিয়ে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার এই হেতাল গ্রামেরতা প্রায় বছর তিরিশ হল তিনি ডাক্তারি করছেন এই গ্রামেবেশ নাম ডাক
পাঁচু চা দিলতিনি চা খাচ্ছেন আর গজগজ করছেনশীতকালতেমন কাউকে রাস্তায় দেখাও যাচ্ছে নাকুয়াশায় ঢাকা চারিদিকপাঁচু পায়ের কাছে বসেপাঁচুর বয়স আনুমানিক ২৩/২৪ হবেমা-বাপ মরা ছেলেগ্রামের লোকেরাই মানুষ করেছে আর এই চায়ের দোকান খুলে দিয়েছেখুব সরল সাদাসিধে ছেলেপড়াশোনা ক্লাস থ্রি অবধি
     "কি হইসে ডাক্তার বাবু? আবার স্বপ্ন দ্যাখসেন? কার স্বপ্ন বাবু?"
     ডাক্তারবাবু নি:সন্তানতিনি আর তাঁর পরলোকগতা গিন্নী দুজনেরই খুব স্নেহের পাত্র এই পাঁচুতাঁদের পরিবারের প্রায় সব কথাই পাঁচু জানেডাক্তারবাবু নিজের ছেলের মতন দেখেন পাঁচুকেসব কথাই বলেনআর এই স্বপ্নের ব্যাপারটা পাঁচু ছাড়া তিনি আর কাউকে বলেনও নি
যা হোকডাক্তারবাবু ব্যাজার মুখে বললেন, "ওবামা"
     "আঁইজ্ঞে কার মা?"
     "আরে মুখ্যু ওবামাআমেরিকার প্রেসিডেন্টআমাদের দেশে যেমন মোদি, তেমনি ওদের দেশে ওবামা।"
     ", মানে কি পধানমনতির?"
     "হ্যাঁ! সে ব্যাটা দেখি সকালবেলা খাতায় নাম লিখিয়ে রুগীর লাইনে বসেখোস-পাঁচড়া হয়েছে একটা লুঙ্গী আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আমার দাওয়াটায় বসে আছে আর বিড়ি ফুঁকছেতার সাথে আমাদের নেতাই-এর মায়ের তুমুল ঝগড়াওবামা নাকি দু'মাসের ঘুঁটের দাম দেয় নিবোঝসুস্থ মানুষ কখোনো এ স্বপ্ন দেখে, তুই বল?"
     পাঁচু কি বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, "আইজ্ঞে স্বপ্নটা কি ভোরের দিকে দ্যাখসেন?”

     "তাতে কি?"

     "না কত্তামা(ডাক্তারবাবুর স্ত্রী) বইলতেন ভোরের স্বপ্ন সত্তি হয়তা হতিই পারেকত মানুষ আইসে আপনের কাসে আর ওবার-মা না আসার কি আছে তো বুঝি নাকেন, গেল বার পুজোর সময় সদরের কোন এইম এল এ সাহেব আইসলেন না! বাতের ব্যাথার ওষুধ নিতিতো? ইনিও দেহেন আইজ কাইলের মধ্যে এইসে পড়ল বুলে", বলে পাঁচু একগাল হাসল
     "তোমার যেমন বুদ্ধি!", ডাক্তারবাবু অন্যমনস্ক হয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন
      পাঁচুর মনটাও ভাল যাচ্ছে না, ডাক্তারবাবুকে কদিন ধরে এমন উতলা দেখেআজ বৃহস্পতিবার বলে না হয় ডাক্তারবাবু রুগী দেখেন না, তাই তাঁর এখানে আসেন, দুটো কথা কনঅন্যদিন তো সেই রাত দশটা অবধি রুগীকার সাথেই আর মনের কথা কবেনকি দুখ্য এই বুড়ো বয়সে কত্তারএই সব ভাবতে ভাবতে পাঁচু বলল, "আরেক কাপ চা দিই কত্তা?"
     বিশ্বম্ভর বাবু অন্যমনস্ক ভাবেই বললেন, "তাই দে।"





আবার স্বপ্ন! 

     আজ দেখলেন তেনজিং নোরগে-কেসক্কাল সক্কাল আসলেন, খাতায় নাম লেখালেন, কিন্তু একি! রুগীদের সারিতে না বসে তিনি বাড়ির সামনের নারকেল গাছ বেয়ে তরতর করে উপরে গিয়ে উঠলেনএদিকে বিশ্বম্ভর বাবু নীচে রুগী দেখতে মাঝে মাঝেই বাইরে এসে তাঁকে অনুরোধ করছেন নীচে নেমে আসার জন্যদু - তিন ঘন্টা হয়ে গেল কিছুতেই তিনি নামতে চাইছেন নামুশকিল হল, নারকেল গাছে চড়ে তো আর চিকিৎসা করা সম্ভব না! আবার এদিকে এত নামী লোক যে যাকে তাকে দিয়ে তাঁকে নামানোও যায় নাকি ফ্যাসাদ!
     ভাগ্যে গদাই-এর ঠাকুমা এসেছিলেন সেই সময়ে ওষুধ নিতেতাঁর খুব উপস্থিত বুদ্ধিগ্রামে তাই নিয়ে বেশ সুনামও আছেঅবশেষে তিনিই একটা উপায় বার করলেন 
গদাই-এর জন্মদিন বলে তিনি কয়েকটা মালপো ভেজেছিলেনবাড়ি থেকে তাই নিয়ে এসে গাছতলায় বসলেন আর বলতে লাগলেন, "অ বাবা নারুগে, নেমে আয় সোনাডাক্তারবাবু তোকে দেখে তো নাইতে যাবেন বাবাকত্ত বেলা হল দ্যাখ দেকিনিমানুষটার তো বয়স হল বল? ওরে লালমুখো, নেমে আয় বাবা!"
     ঠাকুমা তো ডেকেই যাচ্ছেনএদিকে নীচে মেলা বসে গেছেদূর দূর থেকে লোক আসছে দেখতেস্কুলের ভুগোলের কনক স্যার বেশ কিছু উৎসাহী ছাত্র পেয়ে গেছেন দর্শকদের মধ্যেতাদের গোল করে বসিয়ে বোঝাচ্ছেন কোথায় এভারেস্ট, কি করে উঠেছিল, এভারেস্ট-এর উচ্চতা কতআবার পড়াও ধরছেনওই তো কেলে বিশু, যার সাইকেল সারানোর দোকান তাকে নীল ডাউন করিয়ে রেখেছেন এভারেস্ট-এর উচ্চতা তিন বার ভুল বলার পর
     পাঁচু চা বিক্রি করতে লেগে গেছেগবা আর তার বউ পাঁপড় বিক্রি করছেহেডস্যার স্কুল ছুটি দিয়ে ছাত্রদের নিয়ে এসেছেনগ্রামে নোরগেবাবুর জন্য সংবর্ধনা সভার আয়োজন চলছে লাইব্রেরীর মাঠেতার জন্য মহিলা সমিতি রিহার্সাল শুরু করেছেন মাঠের এক কোণে। "উঠ গো ভারতলক্ষী" আর "হও ধরমেতে ধীর" গান হচ্ছে, সব অনুষ্ঠানেই অবশ্য এই দুটো গানই হয়ে থাকেওদিকে গদাই তার মালপো বেহাত হয়ে যাচ্ছে দেখে তুমুল কান্নাকাটি শুরু করেছেবেজায় শোরগোলকিন্তু নোরগেবাবু নারকেল গাছে নির্বিকার
     মোক্ষদা দেবীর বয়স আশি পেরিয়েছে এ বছরতিনিও সব শুনেছেনসব শুনে তাঁর ধারণা হয়েছে কৈলাসে আর এভারেস্টে শুধুই নামের ফারাকতাঁর ধারণা তিনি নিজে কৈলাসে উঠতে না পারলে কি হবে, বাবা তাঁর সাধনায় তুষ্ট হয়ে এমন ক্রান্তদর্শী নোরগেবাবাকে শুধু তাঁরই জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন এই হেতাল গ্রামে। " ভাগ্যিস সকাল থেকে কিচ্ছুটি দাঁতে কাটিনি, এমন পয়মন্তর মানুষ কি আর বিনা তপস্যায় দেখতে আছে!" সুতরাং তিনি নির্জলা উপোসের সঙ্কল্প নিয়ে ফুল বেলপাতা জোগাড় করে বসে আছেন নারকেল গাছেটার নীচেই প্রায়,-"কৈলাসে চড়া মানুষ বলে কথা! তা তাঁর সৎকার করতে হবে না? গেরামের মুখ থাকবে তা না হলে?" এই কথাগুলো মোক্ষদাদেবী বার পঞ্চাশেক শুনিয়েছেন সব্বাইকেসবাই মাথা নেড়ে বলেছে, "তা তো বটেই, তা তো বটেই।"
     এদিকে মোক্ষদাদেবীর প্রাণের বান্ধবী হরিদাসীও এসেছেন একটা গাঁদাফুলের মালা নিয়েতাঁর বক্তব্য, "কৈলাসে যখন উঠেছেন, বৈকুণ্ঠধাম কি আর উঁকি মেরে দেখেন নি? তাও কি হয়?"
এই নিয়ে বেধে গেল তুমুল ঝামেলামোক্ষদা বলেন কৈলাসের নীচে বৈকুণ্ঠ আর হরিদাসী বলেন বৈকুণ্ঠধামের নীচে কৈলাসব্যাস লেগে যা নারদ নারদপ্রথমে মুখে মুখে,তারপর হাতাহাতি, চুলোচুলি... হরি হরি....শিব শিব...

     বিশ্বম্ভরবাবুর ঘুম যখন ভাঙল তখন ওনার মাথা ঝিমঝিম করছে, গা গুলোচ্ছেউঠেই জানলা দিয়ে নারকেল গাছটা দেখলেননা, কিছু নেই,একটা দাঁড়কাক ছাড়াআজ কিছু একটা হেস্তনেস্ত করবেনইহঠাৎ তাঁর মনে হল তারিণী মশায়ের কথাহ্যাঁ উনি কিছু একটা উপায় বার করতে পারেন! ভাবতেই বিশ্বম্ভরবাবুর গলাটা আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসলতাড়াতাড়ি স্নান সেরে দুটো ছোলা বাদাম মুখে দিয়ে, গায়ে একটা শাল চাপিয়ে হনহন করে বেরিয়ে পড়লেন







তারিনী মশায়ের বয়স আন্দাজ ৮৮ হবেখুব জ্ঞানী মানুষকলেজে দর্শন পড়াতেনরিটায়ার হওয়ার পর থেকে এই গ্রামেই পৈতৃক ভিটেতে বাস করেন

     সকাল ৯ টা নাগাদ হন্তদন্ত হয়ে বিশ্বম্ভরবাবু ঢুকলেনএই মাঘের শীতেও বেশ ঘেমে গেছেন
তারিনীবাবু তাঁর উঠোনে একটি ইজিচেয়ারে বসে কাগজ পড়ছিলেনবিশ্বম্ভরবাবু এসেই তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে পাশের একটা মোড়াতে ধপ করে বসে পড়লেন
      "তোমার মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন বিশু?", তারিনী মশায় ওই নামেই ডাকেন ডাক্তারবাবুকে
      ডাক্তার প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে সব বর্ণনা করলেন তারিনী মশায়কেতিনি সব মন দিয়ে শুনলেন আর বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন
      "বুঝলাম বিশুবৌমা চলে যাওয়ার পর থেকে তুমি যে পুরো আটকে নিলে নিজেকে বিশুপুজোকমিটি ছেড়ে দিলে, আমাদের সংগীতচক্রটা ছেড়ে দিলে, এমন সুন্দর বেহালার হাত তোমার! এভাবে কি চলে বিশু?"
     তারিনী মশায় চোখ বন্ধ করে বলে যাচ্ছিলেন, বিশ্বম্ভরবাবু মাথা নীচু করে শুনছিলেন বাধ্য ছেলের মত
     তারিনী মশায় আবার বললেন, "এ তোমার একা থেকে থেকে মাথা গরম হওয়ার ফল বিশুতুমি আবার বেরোওসন্ধ্যেবেলা চেম্বার তাড়াতাড়ি বন্ধ করো দেখিবয়স তো হচ্ছেচন্ডীমন্ডপে চলে এসো আজ থেকেধ্যানেশ কি সুন্দর রামায়ণ পাঠ করছে! আহা! আহা! আজই চলে এসোসব ঠিক হয়ে যাবে বিশু...", বলতে বলতে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন আবেগে
     বিশ্বম্ভরবাবু খুবই মুশকিলে পড়লেনতারিনী মশায় বলে কথা, এক্কেবারে মুখের ওপর নাও বলতে পারছেন না, এদিকে তিরিশ বছরের পুরোন অভ্যেস রাত দশটা অবধি রুগী দেখাকি যে করেন
যা হোক, 'দেখছি' বলে বাড়ি ফিরে আসলেন


     এদিকে স্বপ্ন আরো জটিল হতে শুরু করল

     একদিন দেখলেন ইন্দ্রদেব আর ঊর্বশীর বাসর ঘরে জাম্বুবান ঢুকে ইন্দ্রদেবকে যাচ্ছেতাই রকম খিমচেছেযা হোক সেই সময় যুধিষ্ঠির এসে পড়ায় জোর বেঁচে গেছেন ইন্দ্রদেবঊর্বশী ইন্দ্রদেবকে নিয়ে এসেছেন চিকিৎসার জন্য
     সেদিন দেখলেন বাবর আর পুরু বসে দাবা খেলছেন এমন সময় সাইরেন বেজে উঠলসব বলল, "পালাও পালাও, জাপানী বোমারু প্লেন আসছে।" বাবর পড়িমরি করে দৌড়াতে গিয়ে পায়ের কয়েকটা লিগামেন্ট ছিঁড়ে ফেলেছেনপুরু তাকে নিয়ে এসেছেন চিকিৎসার জন্য
     আরেকদিন দেখলেন মেগাস্থিনিস এসেছেন আর্কিমিডিসকে নিয়েসারাদিন চৌবাচ্চায় শুয়ে শুয়ে আর্কিমিডিসের সারা গায়ে ফাংগাল ইনফেকশন হয়ে গেছে
     অন্যদিন দেখলেন গরুড়জী এসেছেন কিছুটা ঘায়েল হয়েআমাজন জঙ্গলে নাকি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শাখা খোলা হবেতা গরুড়জী গেছিলেন হ্যান্ডবিল বিলি করতেখিদে পেয়ে যাওয়াতে দুটো অ্যনাকোন্ডার স্যুপ খেয়েছিলেনসেই থেকে পেট ছেড়ে দিয়েছে
     তবে শেষ যেটা দেখেছেন তা নিয়ে ওনার অভিযোগটা অনেক কমদেখেন হ্যানিম্যানকে নিয়ে রবিঠাকুর এসেছেনওনারা তাঁর হাতের তৈরি ডাঁটা চচ্চড়ি আর লাউ শাক, গরম ভাত দিয়ে মেঝেতে বসে পরম তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিলেনউফ্... কি যে আবেগঘন মুহুর্ত! উনি এত কেঁদেছিলেন ঘুমের মধ্যে যে সকালে উঠে বালিশের ওয়াড় শুকুতে দিতে হয়েছিলঅবিশ্যি কেন এসেছিলেন তা আর মনে কত্তে পারেন নি সকাল থেকে
     তবে আর নাআজ তিনি চন্ডীমন্ডপ যাবেনইসাইনবোর্ড পাল্টে রুগী দেখার সময় সন্ধ্যে সাতটা অবধি করলেন





চন্ডীমন্ডপে যখন তিনি পৌঁছালেন তখন পাঠ অনেকক্ষণ আরম্ভ হয়ে গিয়েছেবেশ ভীড়সবাই চাদর শাল মুড়ি দিয়ে বসে শুনছেকাউকে চেনা কঠিননেতাই-এর ঠাকুমা, মোক্ষদা দেবী, হরিদাসী দেবী সবাই শুনছেন চোখ বন্ধ করেমোক্ষদা দেবী তো গোটা কম্বল গায়ে জড়িয়েই চলে এসেছেন

     যা হোক বিশ্বম্ভরবাবুকে দেখেই সব সরে সরে জায়গা করে দিলতিনি তারিনী মশায়ের পাশে গিয়ে বসলেনপাঠে বিরতি পড়লতারিনী মশায় বললেন, "তা ছেদ যখন পড়ল রামের ইচ্ছায়, একটু চা খাওয়া যাককি বলেন পাঠক মশায়?" ধ্যানেশবাবু অর্থাৎ পাঠক মশায় নস্যি নেওয়া দাঁত বিকশিত করে ঘাড় হেলিয়ে দিলেন কাৎ করেসভায় সবাই বলে উঠল, "হ্যাঁ হ্যাঁ চা হোক, চা হোক।"
     একজন ছোকরা - বিলে, তারিনী মশায়ের দেখা শোনা করে, সে ছুটে গেল পাঁচুর দোকানে চায়ের অর্ডার দিতেচা এসে গেল, সাথে পাঁচুচা খাওয়া হল, গল্প হল, আবার পাঠ শুরু হল
     হনুমানজী এসেছেন রাবণকে বুঝাতে রামের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য, ওই অংশটা পাঠ হচ্ছে 
     বিশ্বম্ভরবাবু মন দিয়ে শুনতে চাইছেনকিন্তু কিছুতেই পেরে আর উঠছেন নাযতবার তাঁর চোখ সবার দিকে পড়ছে ততবার তাঁর কোন না কোন স্বপ্ন মনে পড়ে যাচ্ছে আর মনটা অস্থির লাগতে শুরু করেছে
     এই তো টেঁপির দাদু স্বপ্নে হিউয়েন সাঙ-কে কি গালাগাল করছিলহিউয়েন সাঙ দোষের মধ্যে বলে ফেলেছিল যে সে চীন থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছে ডাক্তার দেখাবে বলেটেঁপির দাদু কিছুতেই মানবে না সে কথাবলে, "তুমি আমায় মদন পেয়েছ ভোঁতামুখোচীন থেকে হেঁটে হেঁটে আসা! যত সব ঢপের কেত্তন! কেন রে তোদের গাড়ি ঘোড়ার হরতাল, না দিনের বেলায়ও ওই সব ছাঁইপাশ গেলা হয়আমার ঠাকুরদা হেঁটে পুরী যেতে গিয়েই বাঘের পেটে চলে গেছিলেন! আর এ আপদ বলে কি না চীন থেকে হেঁটে আসছে, যেন পথে সমুদ্দুর মরুভুমি পড়েনি" 
     হিউয়েনবাবু যত বোঝান, "আজ্ঞে চীনের পথে ওসব পড়ে না", টেঁপির দাদু তত ক্ষেপে ওঠেনতাঁর বদ্ধমূল ধারণা ভারতের চারিদিকে চার মহাসাগর আর তার ওপারে যত ম্লেচ্ছদের বাস
     ওই যে বাড়ুয্যে মশায়যোগ ব্যায়াম করার খুব শখএকটা আখড়াও খুলে ছিলেনকিন্তু নেতাই-এর ঠাকুমার লেংটি পরা ছেলে দেখতে ভীষণ আপত্তি। "বলি গ্রামে বয়স্থ মেয়ে নেই নাকি লো! ওই ধুম্ব ধুম্ব পেছন বার করে কি চুলোচুলি রে বাবা! রেখে দে ওসব বাড়ুয্যেবামুনের ছেলে কোথায় টোল খুলবে, তা না কি একটা ন্যাংটা ছেলের আখড়া খুলে বসল গা!" আখড়া উঠল
     সে আখড়ায় এখন মুদির দোকান দিয়েছে ওনার বড় ছেলে 
     ওই বাড়ুয্যেই হিটলারকে কি নাকানি চোবানি খাইয়েছিল যোগ ব্যায়াম করিয়ে! অবশ্যই স্বপ্নেহিটলার এসেছিলেন ওনার পাইলসের ওষুধটা নিতেপড়ে গেলেন বাড়ুয্যের খপ্পরে! এই আসন, সেই আসন করিয়ে হিটলারের শরীরের সব কলকব্জা তখন খুলে যাওয়ার যোগাড়সে কি কান্না হিটলারের বাচ্চাদের মত 
     শেষে আবার নেতাই এর ঠাকুমা এলেন নাড়ু নিয়েনেতাই তিনবারের বার এক চান্সেই ক্লাস সিক্সে উঠেছে বলে তিনি নাড়ু বানিয়েছিলেনহিটলারকে তো নাড়ু দিয়ে শান্ত করা গেলকিন্তু ওদিকে নেতাই জুড়ে দিল কান্না, "অ্যাঁ অ্যাঁ... আমি আর কোনোদিন যদি পাশ করেছি দেখো.... আর কক্ষোনো করব না... আমার পাশের নাড়ু ওই হতচ্ছাড়া শুঁটকে লোকটাকে খাওয়ানো অ্যাঁ অ্যাঁ....."

     "ডাক্তার বাবু বাড়ি যাবেন না?" পাঁচুর গলা না!
     আরে তাই তোপাঠ তো কখন শেষসবাই তাঁর মুখের দিকে হাঁ করে চেয়েছি ছিকি লজ্জাযা হোক তিনি কোন রকমে এটা ওটা বলে বাড়ির দিকে রওনা দিলেনতারিনী মশায় কোন কথা না বলে ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলেন অন্ধকারের দিকে, "বিশুর একি হল! এত কি ভাবে?"
     বিলে বলল,"ও দাদু তোমার আবার কি হল? চল বাড়ি যাবে না?"
     তারিনী মশায়ের ঘোর কাটলবললেন " হ্যাঁ হ্যাঁ চ চ..."





কিচ্ছু হল নাবিশ্বম্ভরবাবু পর পর বেশ কয়েকদিন গেলেন সন্ধ্যেবেলা চন্ডীমন্ডপেপুরো লঙ্কাকান্ড শুনলেনতা সত্ত্বেও কাল রাতে যা হল! আর তিনি চন্ডীমন্ডপে যাচ্ছেন না

     সেই দু:স্বপ্নএবার স্বয়ং রাবণ, ভাবা যায় ব্যটার স্পর্ধা! 
     তার দশটা মাথাকেন যে ওর বাবা ছোটবেলাতেই কাটিয়ে নেন নি, কে জানেসে এসেছে তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্যতার একটা মাথা ঘুরছে, একটা ব্যাথা করছে, আরেকটাতে চুলের ভিতর ঘা, আরেকটাতে আরো কি সবতার উপর এতগুলো মাথা ঘাড়ে করে বয়ে বয়ে ধরিয়েছে স্পন্ডেলাইটিসএ সামলানো যায়! বলি মাথা দশটা হলে কি হবে? ঘাড় তো একটা!
     এদিকে সে আসছে দেখে গ্রামের ভীতু ছেলেগুলো ভয়ে ঘরে সেঁদিয়ে, নেতাই-এর তো দাঁতকপাটি লেগে ধুম জ্বরস্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছেন হেডস্যারওদিকে থানায় রিপোর্ট করতে গিয়ে ছিলেন গ্রামের মাতব্বরেরাতাঁরা ফিরে এসেছেনথানার বড়বাবু নাকি রাবণের ভীষণ ভক্ত, তাই রিপোর্ট নেবেন না
কি হুলুস্থুলু কান্ডশেষে সভা ডেকে ঠিক করা হল বিশ্বম্ভরবাবুকেই গ্রাম ছেড়ে দুরে গিয়ে চেম্বার করতে হবেএকি কথা! তিনি আপত্তি জানাতে যাবেন, এমন সময় ঘুমটা ভেঙে গেল

     সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ইস্তক ওনার মেজাজ বিগড়ে আছেকিচ্ছু খেলেন নাসাইকেলটা নিয়ে সারদিন এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে বেড়ালেন 
     বিকালবেলা গ্রামের বাইরে দিয়ে যাওয়া একটা সরু খালের ধারে এসে বসলেনবাচ্চারা দুরে খেলছে, আওয়াজ আসছে ওদের চীৎকারেরতাঁর মনটা খুব খারাপ হয়ে আছেভাবছেন পাগল হয়ে যাবেন নাকি? না আত্মহত্যা করবেন... মাথার মধ্যে সব ভুলভাল চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছেতিনি চাইলেও থামাতে পারছেন না আজ

     হঠাৎ শুনলেন খুব চীৎকার, চেঁচামেচিপিছন ফিরে দেখেন বড় ছেলেদের সাথে ছোট ছেলেদের ভীষণ মারামারি বেধে গেছেদৌড়ে গেলেনজানলেন, কারা এই মাঠে খেলবে তাই নিয়ে ঝামেলাবিশ্বম্ভরবাবুকে চেনে না এমন বাচ্চা বুড়ো কেউ এ গ্রাম কেন, আশে পাশে চব্বিশটা গ্রামেও নেই 

তিনি বললেন, "ঠিক আছে বড়রা পনেরদিন আর ছোটরা পনেরদিন করে বল খেলবে, একদিন অন্তর অন্তর
     "আজ যখন বড়রা খেলতে শুরু করে দিয়েছে তখন ওরাই খেলুককাল তোরা খেলিসআবার পরের দিন বড়রা।", সবাই মেনে নিল
     "তা হলে এখন আমরা কি করব?", একজন খুদে খেলোয়াড় জিজ্ঞাসা করল
     "তুমি গল্প বলতে পারো?", আরেকজন খুদের প্রশ্ন
     "হ্যাঁ হ্যাঁ, গল্প গল্প", বলতে বলতে বিশ্বম্ভরবাবুর পাঞ্জাবী ধরে এক প্রকার টেনে নিয়েই তাঁকে ওরা খালের ধারে যেখানে ওনার সাইকেল রাখা ছিল - নিয়ে বসালনিজেরা বসল গোল হয়ে তাঁকে ঘিরেকি গল্প বলেন? খুব মুশকিলে পড়লেন তিনিগল্প বলার অভ্যাসও নেইহঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল রাতে দেখা রাবণের স্বপ্নটার কথাব্যাস বলতে শুরু করলেন
     যখন থামলেন তখন সন্ধ্যে হব হবদেখেন বড়দের দলও কখন এসে বসে পড়েছে তাঁকে ঘিরে
     "আরে চল চল অন্ধকার হয়ে গেল যে", বলেই তিনি সাইকেলে চড়ে বসলেনমনটা কেন জানি হঠাৎ খুব খুশী খুশী লাগছে অনেকদিন পরযেন কিছুই হয় নি এতদিনযা হোক, সাইকেলে প্যাডেল করতে যাবেন, এমন সময় একজন খুদে সদস্য ওঁর পায়জামা টেনে ধরল

     তিনি অবাক হয়ে সাইকেল থেকে নেমে পড়লেন, বললেন, "কি রে?"

     "কাল আবার আসবি তো?", খুদে খুব আবদারের সুরে বিশ্বম্ভরবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল
     কি হল বিশ্বম্ভরবাবুর তিনি বুঝলেন নাতাঁর নাকের কাছটা টনটন করে উঠল, চোখদুটো জ্বালা জ্বালা করে উঠলআটকাতে পারলেন না নিজেকেদু'ফোঁটা অবাধ্য জল চোখ থেকে গাল গড়িয়ে পাঞ্জাবীতে পড়লভাগ্যিস অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, না হলে কি লজ্জা! না, লজ্জা কিসের? 
কতদিন পর তাঁর মনের ভিতরটা হাল্কা লাগছেমনে হচ্ছে খুব চীৎকার করে কাঁদেন, যাতে মনোরমা শুনতে পায়সামলে নিলেন
     বাচ্চাটার গালে হাত দিয়ে বললেন, "আসব"

     এরপরের গল্পটা খুব সোজাবিশ্বম্ভরবাবু ভীষণ ব্যস্তসারাদিন তাঁর বাড়িতে কচি-কাঁচার ভিড়অবৈতনিক প্রাইমারী স্কুল খুলেছেন তিনিগ্রামের অনেকেই পড়ায় সেখানেবাড়ুজ্যে যোগব্যায়াম শেখায়, তারিনী মশায় ইংরাজী পড়ান, আরো অনেকে পড়াননেতাই-এর ঠাকুমা পূজো পার্বণে মালপো, নাড়ু বানিয়ে আনেনসে এক কর্মযজ্ঞ
     আর স্বপ্ন? তার আসার সময় কোথায়?



(অলঙ্করণঃ সুমন দাস)

No comments:

Post a Comment