স্টেশান
======
চৈতি ভিল্লুপুরম স্টেশানে নেমেই বমি করল। এ সময়ে বৃষ্টি হয় না। কিন্তু আজ হচ্ছে। একদিক থেকে ভালোই, গরম যা পড়ে এই সময়টা।
চৈতি স্টেশানের বাইরে সিঁড়িতে বসে। চোখটা বন্ধ। মনোরমা ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করে জিজ্ঞাসা করল, জল খাবি?
চৈতি ইশারায়, না বলল।
মনোরমা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কী যে অসহায় লাগে এক-একসময়ে। যেন কোথাও কোনো অবলম্বন নেই। অথচ আছে। অবলম্বন একেবারে না থাকলে এতদিন বেঁচে আছে কী করে তার মত মানুষ? তার মত হাজার একটা মানুষ, এত ঘেন্না, এত অত্যাচার সহ্য করেও?
মনোরমা শাড়িটা একটু উঁচু করে তুলে, ব্যাগ থেকে ছাতাটা বার করে, ব্যাগটা চৈতির পাশে রেখে বলল, আসছি রে, বলে, রাস্তায় নেমে গেল। ছাতায় মানছে না বৃষ্টি। সামনের ওষুধের দোকানটা অবধি যেতেই হবে। ওষুধটা আনলে একটু স্বস্তি পাবে মেয়েটা।
মেয়েটা!
হাঁটতে হাঁটতে নিজের মনের মধ্যে উচ্চারিত শব্দেই নিজের হাসি পেল। মেয়ে সে? লোকে ডাকে হিজড়া, ছক্কা, আর সমাজসেবীরা ডাকে ট্রান্স। সে নিজেও সমাজকর্মী যদিও। মুম্বাই থেকে একটু দূরে, ছোটো একটা শহরে তার একটা এনজিও আছে - সুচেতনা। সেও মেয়েদের নিয়ে কাজ করে। তার মত মেয়েদের নিয়ে।
ওষুধ নিয়ে, টাকাটা ইউপিআই-তে মিটিয়ে ফিরতে যাবে, দোকানের ছেলেটা বলল, ভালো আছ?
চিনতে পেরেছে? মনোরমা ছাতাটা একটু তুলে জিজ্ঞাসা করল, চেনো আমাকে?
ছেলেটার চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। বলল, তুমি আর তোমার বন্ধু আমাদের দোকান থেকে গত বছর কণ্ডোম কিনলে না? তোমাদের মত মেয়েকে সেই প্রথম আমি কণ্ডোম বিক্রি করেছিলাম…. মনে থাকবে না?
মনোরমা দাঁড়ালো না। এরপরের প্রশ্নগুলো ভীষণ চেনা। কেউ উচ্চারণ করে, কেউ করে না। তোমাদের কোথায় লাগায়, কী করে? বাচ্চা হয় না? অ্যাবরশান করতে হয়?
চৈতি চোখ খুলে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। কী চেহারা হয়েছে মেয়েটার! গত বছর ধরা পড়েছে, এইচআইভি পজিটিভ। এই কুভাগাম উৎসবেই ধরা পড়েছে।
হোটেল
=======
প্রায় দশ বছর হল এই উৎসবে আসছে মনোরমা আর চৈতি। আগে আরো অনেকে আসত। এখন অনেকে এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেছে। অনেকে নেই। চৈতি আর মনোরমা থেকে গেছে। অনেকে বলে তাদের দেখলে মনে হয় যেন একই মায়ের পেটে জন্মানো দুই বোন তারা।
চৈতি আর মনোরমা একটা অটোতে উঠল। হোটেলে যাবে। আজকের দিনটা এখানেই থাকবে। কাল উৎসবে যাবে। এখান থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার। গাড়ি ঠিক করে নেবে। প্রতিবছর নেয় একই লোকের থেকে। সুন্দরম্ ট্রাভেলস। ওরা একবার বলেছিল, এই উৎসবের পরে রমণ মহর্ষি'র আশ্রমটা ঘুরে আসতে, অরুণাচলমে। কোনোবার যাওয়া হয়নি।
সন্ধ্যে হল। চৈতি ঘুমাচ্ছে। খায়নি কিছু দুপুরে। মনোরমা হোটেলের ব্যলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি ধরে গেছে। আকাশ পরিষ্কার। তারা উঠেছে।
চৈতি এসে দাঁড়ালো পাশে। বলল, দেখ না কফি দিয়ে যায় যদি।
মনোরমা হাতঘড়িটা দেখল। সাড়ে সাতটা বাজে প্রায়। ফোন করল, দিয়ে যাচ্ছে বলল। চৈতির চিনি দিয়ে তারটা চিনি ছাড়া। মনোরমার ডায়েবিটিস, প্রায় দশ বছর হল। মামাবাড়ির জিনে ছিল। চৈতি ওয়াশরুমে গেল। মনোরমা দুটো চেয়ার বার করে আনল বারান্দায়। কফি আসছে। চৈতিও।
পুরানো কথা - পুরাণ
===============
পুরাণ পুরোনো হয় না। তাদের কথা হয়। হারিয়ে যায়।
চৈতি বসল সামনে এসে। হলুদ একটা নাইটি পরে আছে। চোখগুলো কোটরে ঢুকে। হঠাৎ হাতটা বাড়িয়ে, মনোরমার হাতের উপর রেখে বলল, আমি যদি আর না ফিরি মনো? আমাকে এখানেই দাহ করে যাবি? ইরাবানের মত?
আগে হলে এ কথায় চমকে উঠত মনোরমা। আঘাত লাগত। এখন শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। কফির কাপটা হাতে ধরে কাপের সবটুকু উষ্ণতাকে হাতের চামড়া পোড়াতে দিল। কিন্তু অত তাপ কি আছে ওর? পারল না। শুধু জ্বালা ধরালো।
চৈতি বলল, ইরাবানের মায়ের নাম কী ছিল যেন মনো? ঊলূপী না? অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল?
মনোরমা চৈতির হাতটা মুঠোর মধ্যে ধরে বলল, হ্যাঁ। একটু হেসে বলল, ঊলূপীর নাকি আগে বিয়ে হয়েছিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর সে নাকি কামের আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল। অর্জুনকে দেখে আগুনে ঘি পড়ে। সেই আগুনের তাপেই জন্মায় আরাবান, বা ইরাবান।
চৈতির হাতটা কঙ্কালের মত। কয়েকটা হাড়। তারা দু'জনেই একটা এনজিও-তে বড় হয়েছে। কিন্তু চৈতিটা পড়তে চাইল না। ক্লাস ফাইভ অবধি পড়ে পড়া ছেড়ে দিল। মনোরমা গ্র্যাজুয়েশান করেছে। মারাঠা ভাষায়। তার কবিতা লিখতে ভালো লাগে। গল্প পড়তে ভালো লাগে। চৈতিও গল্প শুনতে ভালোবাসে। আজকাল সারাটাদিন গল্প শোনার জন্য মুখিয়ে থাকে। যেন এই অসম্পূর্ণ জীবনের সব অভিজ্ঞতা শুধু শুনে উসুল করে নেবে। এমন জেদ!
মনোরমা কোনোদিন এই সব সমাজসেবা-টেবার মধ্যে জড়াতে চায়নি। তার মনে হত নিজের মধ্যের নিঃস্বতাকে কাটাতেই এইসব কাজ করে মানুষ। আসলে সবটাই শুধু নিজের থেকে পালানোর জন্য। নিজের নিঃসঙ্গতা থেকে পালানোর জন্য।
চৈতি তার দিকে তাকিয়ে আছে। বলল, আরাবানের গল্পটা বলবি আবার?
মনোরমা নতুন গল্প কত খুঁজবে? একই গল্প বারবার বলে। নিঃসঙ্গ মানুষের গল্প এক বড় আশ্রয়। অন্য মানুষের গল্প। যার মধ্যে নিজেকে খোঁজা যাবে আবার নতুন করে।
গল্প
====
অর্জুন আর ঊলূপীর সন্তান আরাবান। মহাভারতের যুদ্ধের সময় পাণ্ডবদের বলি দিতে হবে কাউকে। যুদ্ধজয়ের জন্যেই দিতে হবে। কাকে দেবে? কে হবে যোগ্য বলি? তিনজন যোগ্য। শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন আর আরাবান। শ্রীকৃষ্ণকে কি বলি দেওয়া যায়? তিনি তো লীলাময় অবতার। অর্জুনকেও না, তবে যুদ্ধ করবে কে? তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন, আরাবানকেই বলি দাও। কালীর সামনে আরাবানকে বলি দেওয়া হবে। কিন্তু সে গোটা যুদ্ধটা দেখবে। তার মাথা টাঙানো থাকবে যুদ্ধক্ষেত্রে। আর একটা সাধ আরাবানের। এই জগত থেকে সম্পূর্ণ লুপ্ত হওয়ার আগে সে চায় বিয়ে করতে।
কী সাধ না? যে মানুষটা কাল থাকবে না, তারও ইচ্ছা একজনকে নিজের করে পাবে এ জগতে। একদম একাকীত্বে কেউ যেতে চায় না, একা যেতে হবে জেনেও।
কিন্তু কে বিয়ে করবে আরাবানকে? তবে তো সে একদিন পরেই বিধবা হবে? কেউ বিয়ে করতে চায় না। তখন শ্রীকৃষ্ণ নিজের মোহিনীরূপ ধারণ করে বিয়ে করলেন আরাবানকে।
গানে শ্রীকৃষ্ণকে রাধা হয়ে রাধার ব্যথা অনুভবের কথা শুনেছে মনোরমা। কিন্তু এখানে তো শ্রীকৃষ্ণ বৈধব্যের যন্ত্রণা সহ্য করছেন। দারুণ যন্ত্রণা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ কি আরাবানকে ভালোবেসেছিলেন? নাকি পাণ্ডবদের জয়ের জন্য যে আত্মত্যাগ আরাবান করেছিলেন, সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই এটা করেছিলেন? একি ছল না? কে উত্তর দেবে?
চৈতি বলে ক'টা বিয়ে ভালোবাসায় দাঁড়িয়ে হয় মনো?
আসলে আরাবানের এ গল্প মহাভারতের অংশ হলেও, আজ তার সঙ্গে যোগ অনেক ক্ষীণ। অনেক অনেকবার বলা-শোনা এ গল্প, লোককথা হয়ে তামিলনাড়ুর মানুষের মুখে মুখে কত ধারায় বয়ে চলেছে সে শ্রীকৃষ্ণই জানেন।
উৎসব
=======
চৈতি ঘুমালো। রাতে খেল না। বমি হচ্ছে শুধু। বারবার মনোরমা বলেছিল, না আসতে এবারের উৎসবে। কিন্তু চৈতির জেদ। এটাই তো তার শেষবারের মত আসার সুযোগ। এরপর?
এরপরের কথা মনোরমা জানে না আর। ভাবতেও চায় না। উৎসব চলবে আঠারোদিন। মানে যতদিন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলেছিল আরকি। তার মধ্যে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন আছে। চৈতি চারবার হেঁটেছিল র্যাম্পে। একবারও হয়নি কিছু যদিও। মনোরমা একবারও নাম দেয়নি। তার মানুষ দেখতে ভালো লাগে। নগ্ন মানুষ।
উৎসবে অনেক পুরুষ আসে। চলে উদ্দাম যৌবনযাপন। লোকে বলে বেশ্যাবৃত্তি। একদিক থেকে দেখলে তো তাই। কিন্তু সত্যিই কি তাই? যৌনতার ঠিক-ভুলের মাপকাঠি যে সমাজ ঠিক করে দিয়েছে, তারা কি সেই সমাজের অংশ? ক্ষুধার্ত মানুষকে উপোসের বিধান দেওয়াই যায়। কিন্তু সে শুধু বিধানের গৌরবকে অক্ষুণ্ণ রাখতে। ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তি শোনে কি সে সমাজ?
মনোরমা ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছে কাম-ক্রোধ-লোভ নাকি নরকের দ্বার। ত্যাগ করার কথা। কিন্তু এই তিনটেকে এক নিশ্বাসে উচ্চারণ করে কী করে মানুষ? তারা নাকি প্রাজ্ঞ ছিল? ক্রোধ আর লোভ না হয় মানা গেল। সে মনের উপর বাইরের জগতের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু কাম? সে তো খিদেতেষ্টার মত শরীরেই জন্মায়। সেকি শুধুই প্রতিক্রিয়া? সেকি স্বতঃপ্রণোদিত কল্পনাও নয়?
চৈতি বেশির ভাগ দিনই অসুস্থ থাকল। হোটেলের ঘরে শুয়েই কাটালো। মনোরমা মাঝে মাঝে উৎসবে এলো। মেলায় ঘুরল। অন্ধকারে দাঁড়ানো, উল্লাসে মাতা নরনারীকে দেখল। যারা অনেকেই সামাজিক অর্থে নারী নয়, পুরুষ নয়। কিন্তু এখানে একদিন সবের ছাড় আছে। এমনকি সমাজেরও। নয়? নইলে এত নেতামন্ত্রী আসে কেন এই উৎসবের আয়োজনে? তারা জানে না এখানে এসবও চলে? এমনকি ধর্ষণ! এমনকি শারীরিক নিগ্রহ! সব জানে। আর জানে বলেই এত আয়োজন করে স্বাস্থ্যসেবার লোকজন ধরে ধরে রক্তপরীক্ষা করাচ্ছে। এইডসের জন্যই তো। অসুরক্ষিত যৌনসংসর্গতে নিষেধ আনতে বলছে। যেখানে তাদের জীবনটাই সুরক্ষিত নয় সেখানে যৌনতাকে সুরক্ষিত রাখবে কে? আর রাখতে দেবেই বা কে?
কাল পূর্ণিমা। কাল মোহিনী উৎসব। কাল কি আসতে পারবে মনোরমা? আসতে পারবে চৈতি?
মনোরমা কুথাণ্ডাভার মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। এই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়েই চৈতি বলেছিল, সে পজিটিভ। তার রিপোর্ট এসেছিল।
সেবারে মোহিনী উৎসব তাদের দু'জনের জন্যেই ছিল অন্যরকম। মনোরমা এনজিও-তে সেক্রেটারি হয়েছিল। মারাঠি ‘অস্মিতা’ পত্রিকায় তার জীবনী ছাপা হয়েছিল। দু'জনেই ঠিক করেছিল তারা সেলিব্রেট করবে এখানে এসে। দু'জনেই দুটো কাঞ্জিভরম শাড়ি কিনেছিল। মনোরমা কিনেছিল লাল। চৈতি কালো।
মোহিনী উৎসবের দিন। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। তারাও তৈরি। বিয়ের জন্য। অত সাজ কোনোদিন সাজেনি মনোরমা। এই উৎসবে এইদিন তাদের মত যারা তাদের সবার সঙ্গে আরাবানের বিয়ে হয়। একরাতের জন্য। মঙ্গলসূত্র পরানো হয়। চুড়ি পরানো হয়। নাচ-গান-হাসি-উল্লাস কী না হয়! ফেটে পড়ে সব আনন্দে। যেন আজ এ পৃথিবীর মাটি কাদা আর পাথরে না, শুধুই নরম ঘাসে তৈরি। পা ফেলতে কোথাও কোনো বাধা নেই। আড়াল নেই কারুর সঙ্গে কারো।
সারারাত কী হুল্লোড় না করেছিল তারা। অবশ্য ঘন্টাখানেকের জন্য চৈতি ছিল না তার সঙ্গে। মনোরমা জানে কোথায় গিয়েছিল। কার সঙ্গে গিয়েছিল সেও হয় তো জানে। লোকটা অনেকক্ষণ ধরে চৈতিকে ফলো করছিল। একটা লাল জামা আর লুঙ্গি পরে এসেছিল। সুপুরুষ। বুকের বোতাম খোলা। লোমশ বুকে চাঁদের আলো এসে পড়েছিল, মনোরমা দেখেনি। নিশ্চয়ই দেখেছিল চৈতি। দেখেছিলই তো। অন্যবারের মত সেবারেও তার নাম্বার নিয়ে এসেছিল। সেভ করেছিল। ওসবের আগে অনেকেই নিজের নাম্বার দেয়। হয়ে গেলে সব অন্য মানুষ। কেউ কেউ ভদ্রতার খাতিরে এক-আধবার যাও বা ফোন তোলে। অনেকেই তোলে না আর। ব্লক করে দেয়।
পরেরদিন বৈধব্যের উৎসব। সবার মঙ্গলসূত্র ছিঁড়ে ফেলা হয়। চুড়ি ভেঙে ফেলা হয়। তারপর সাদা থান পরে একে অন্যকে জড়িয়ে কান্না। কী ভীষণ কান্না!
অভিনয়?
তাদের কাঁদতে অভিনয় লাগে না। কান্না চাপতে অভিনয় লাগে। বহুবার লাগে। এত অপমান, এত লাঞ্ছনা, এত নিগ্রহের শিকার তাদের শরীর আর মন যে আলাদা করে কাঁদার কারণ খুঁজতে হয় না। যৌনতায় যেমন অভিনয় করে না তারা, ভালোবাসায় অভিনয় করে না, কাঙালপনায় অভিনয় করে না… ঠিক তেমনই কান্নাতেও করে না। আসলে তারা অভিনয় করতে পারে না। জানে না। অভিনয় তো করে সমাজ। অভিনয় করতেও শেখায় সমাজ।
ফেরার ট্রেন
===========
চৈতি মোহিনী উৎসবের দিন রাতেই মারা গেল। মনোরমা কাঁদল না। হয় তো জানত। সে এবারে চায়নি মোহিনী উৎসবের এইসব বিয়েটিয়ের আচার-অনুষ্ঠানে যেতে। চৈতির জেদে যেতে হয়েছিল। ফিরল যখন চৈতি নেই। বাথরুমে নগ্ন শুয়ে। কল খোলা। চিৎ হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে। শাওয়ারের জল পড়ছে সারাটা শরীর ভাসিয়ে।
মনোরমা তার দাহকাজ সেরে ভিল্লুপুরাম স্টেশানে বসে। একা। কান্না নেই। আশা-আকাঙ্ক্ষা কিচ্ছু নেই। আসলে কোনো অনুভবই নেই। ট্রেন দেরি আছে। চৈতির টিকিটটা ক্যান্সেল করেনি। তার আর চৈতির সাইড আপার আর লোয়ার। সে আপারে চলে যাবে। যদি কান্না পায়? বলা তো যায় না। একদল স্বাভাবিক, সামাজিক মানুষের যাত্রীদলের মধ্যে একা হিজড়ের কান্না কেমন লাগবে? নিন্দা হবে, ভয় নেই। সবাই বড্ড ঘেন্না করবে। ওতে চৈতির অপমান হবে।
সেই ওষুধের দোকানে এলো। মাথা ব্যথার ওষুধ লাগবে। সেই ছেলেটা। যদি বিয়ে হত মনোরমার, যদি ছেলে হত, তার এই বয়েসই হত হয় তো।
টাকাটা দিয়ে মনোরমা ফিরছে। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বন্ধু আসেনি?
মনোরমা বলল, না। মরে গেছে।
ছেলেটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। হিজড়ে মরলে কীভাবে নিতে হয় জানে না তো। শেখায়নি তো সমাজ। সারা পৃথিবী জুড়ে একদল হিজড়াই তো নিজেদের অবমানুষ হওয়ার মাশুল, নিজেদের মান-সম্মান সমাজের পায়ের তলায় দিয়ে বেঁচে থাকে। টিকে থাকে কোনোভাবে। তারা আবার জন্মায়, মরে নাকি?
মনোরমা বলল, ভালো থেকো।
মনোরমা জানে, সে আর কোনোদিন আসবে না। একবারে যাওয়ার আগে এই একটা কথাই বলে যাওয়ার ইচ্ছা হল, ভালো থেকো। আর কী বলার থাকতে পারে? আর কে-ই বা শুনবে? আসলে কী চায় মানুষ? সুখ? শান্তি?
সে তো অর্ধসত্য উত্তর। মানুষ আসলে চায় একটু সম্মান। মানুষের সম্মান। জাস্টিস।
No comments:
Post a Comment