Wednesday, May 28, 2014

এলে নয়ন মাঝে

বেশ কিছু বছর আগের কথাশিয়ালদা থেকে কোনো একটা আপ ট্রেনে উঠেছিবাড়ি ফিরছি, কাঁচরাপাড়ায়সকাল এগারোটার আশেপাশে হবেবর্ষা কাললাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে কয়েকদিন ধরেফাঁকা ট্রেনআমি দু'পাশের জানলা থেকে বেশ কিছুটা সরে মাঝামাঝি বসলামট্রেন ছাড়লআমি একটা বই বার করে পড়তে শুরু করলামট্রেন এগোতে লাগল আর ভীড়ও আসতে আসতে বাড়তে লাগল 
     আগরপাড়া থেকে একটা পরিবার উঠে আমার পাশের সিটগুলোতে বসলবয়স্কা মা, তাঁর ছেলে, ছেলের বউ আর দুই নাতিছেলে দুটির বয়স বছর দশের মধ্যেই হবেপ্রতিদিনের খেটে খাওয়া পরিবারপ্রত্যেকে তাঁদের বহু ব্যবহৃত একটাই ভাল পোশাক পরেছেন বলে মনে হলশুধু বাচ্চা দুটোর গায়ে নতুন দুটো জামাআশ্চর্য হলাম ভদ্রমহিলার পুত্রবধূর মুখে চোখ পড়তেআমার খুব নিকটাত্মীয়ার সাথে অদ্ভুত মিলচোখ নামিয়ে বইতে আনলাম আর ভাবতে লাগলাম এত মিলও হয়! 
     যা হোক ইতিমধ্যে ভীড় বেড়েছে আর বাচ্চা ছেলেদুটোর চীৎকারে পড়া মুলতুবি রেখে জানলার দিকে চেয়ে বসে থাকলামবর্ষাস্নাত মেঘলা বেলা চারিদিক, মনে কেমন ছুটির আমেজ তৈরি করছিল 
     পাশে শুনতে পাচ্ছিলাম হকারদের আনাগোনা, বাচ্চা দুটোর ক্রমাগত বায়না আর তার সাথে বাবার প্রত্যাখ্যান 
     বেশ কিছুক্ষণ পর এক লজেন্সওয়ালা উঠলেন২ টাকায় চারটে লজেন্সলাল-হলুদ এই লজেন্সগুলো আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছিএখোনো ক্যাডবেরি, পার্কের যুগেও এরা স্বমহিমায় নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে দেখলে অবাক লাগে! 
ভদ্রলোক কিনলেনবাচ্চাদুটোর চোখে ঝিলিক খেলে গেলতিনি প্রথমে একটা লজেন্স ওনার মা-কে দিলেন, একটা প্যাকেট বাচ্চা দুটোকেআর দুটো লজেন্স নিজের হাতে নিয়ে বসে রইলেন 
বুঝলাম মায়ের সামনে স্ত্রী কে দিতে লজ্জা বোধ করছেনওঁর মা হঠাৎই ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে জানলার দিকে ঘুরে বাইরের অভ্যস্ত দৃশ্যকে অতিপ্রাকৃতিক করে ব্যাখ্যা শুরু করলেনআমার হাসি পেল, হঠাৎ মাঠে চরা গরুও কি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হয়ে উঠল 
     তরুণী বধূটির মুখে তখন সলজ্জ হাসিওঁর স্বামী অতি দ্বিধায় ধীরে ধীরে সেই অমূল্য সম্পদ লজেন্সটি স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলেন, বধূটি আঁচলের নীচে হাতটি এগিয়ে, সেটি নিয়ে মাথা নীচু রেখেই মুখে পুরলেনতারপর আরক্ত মুখে যে দৃষ্টিতে তাঁর স্বামীর দিকে তাকালেন মনে হল এই ক্ষণটিকে আস্বাদন করার জন্যই বিধাতা এই সংসার রচনা করেছেনস্বামীর মুখে তখন স্বর্গীয় পরিতৃপ্তি 
     আমার সব পুর্ব চিন্তা গেল ভেসেবাইরের মেঘলা আকাশের মত মনের কোণেও মেঘ জমলমনে হল পবিত্র হলাম এক মুহুর্তে 

     এর পরের ঘটনাটা সেদিনের 
     যাচ্ছি কোলকাতায়ডাউন ট্রেনখুব ভীড়ে দাঁড়িয়েচমকে গেলাম কাঁকিনাড়া ছাড়তেদূরের সিটে সেই বধূটি! একি চেহারা হয়েছে! আমার আত্মীয়ার সাথে মুখের মিলটিই মনে করিয়ে দিল বোধহয় সেই দিনের মুহুর্তগুলোতাঁর সারা শরীরে পরিশ্রমের ছাপসিঁদুরহীন এলোমেলো চুলভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলপারলাম না স্থির থাকতেজানলাম ক্যান্সার যবনিকা টেনেছে আমার দেখা সেই অধ্যায়েরআমার চারপাশের ভীড় গেল হারিয়েস্থির হয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালামচোখ পড়ল ওঁর জানলার বাইরে তাকানো চোখের ওপরকি শান্ত ওঁর চোখ দুটোবুঝলাম, বিধাতা শুধু প্রেমের পাত্রটিই ভাঙতে পেরেছেন, পারেন নি একবিন্দু প্রেমের সুধা কেড়ে নিয়ে এঁকে নি:স্ব করতেইনি তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে তা হৃদয়ে আগলে রেখেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী তপস্যায়ক্ষণিকের জন্য মৃত্যুকেও কি অসহায় দুর্বল বোধ করলাম এই নীরব তপস্বিনীর সান্নিধ্যেপবিত্র হলাম


No comments:

Post a Comment