ঘটনাটা ঘটল কান্তাবাবু অফিস থেকে ফেরার পর।
কান্তাবাবু মানে আমাদের কান্তাচার্য্য। একটা সাধারণ চাকরি করেন কোলকাতায়,
বেসরকারি। শ্যামনগরে পৈতৃক বাড়ি। বাড়িতে বর্তমানে তিনি, তাঁর গিন্নি আর বারো বছরের
ছেলে। এই নিয়ে তাঁর সংসার। মোটামুটি স্বচ্ছল অবস্থা। সমস্যাও কিছু নেই তেমন
সংসারে। তবে যেটি আছে তা হল কান্তাবাবুর ভাবার বাতিক। সে অনেক কথা। বলতে গেলে
আজকের গল্পটা আর বলা হবে না। শুধু এটুকু বলি তিনি যখন ছোট ছিলেন পুকুরে স্নান করতে
যাওয়ার সময় বাড়ির চাকর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকত, পাছে তিনি ভাবতে শুরু করেন আর সাঁতার
কাটতে ভুলে গিয়ে ডুবে যান। এরকম হয়েছিল নাকি কয়েকবার।
যা হোক। আজকে হল কি, উনি তো অফিস থেকে ফিরেই স্নান সেরে লুঙ্গী পরে খালি গায়ে পাখা
চালিয়ে খবরের কাগজ নিয়ে, "কই গিন্নি" হাঁক ছেড়ে বসলেন। অমনি
গিন্নিঠাকুরণও একবাটি মুড়ি আর কয়েকটা নারকেল কাটা ওনার জন্যে দিয়ে গেলেন। প্রথম
গ্রাসটা মুখে তুলেছেন কি তোলেননি, ওনার মাথায় খেলে গেল প্রশ্ন, "সব কিছুরই
একটা কারণ থাকে, কিন্তু সব কিছুরই কি একটা উদ্দেশ্যও থাকে?"
ব্যস! মুড়ি রইল মুখ ভর্তি, চিবাতে ভুলে ভাবতে লাগলেন, "এই যে
আমি মুড়ি চিবাচ্ছি এর কারণ তো খিদে, কিন্তু উদ্দেশ্য কি? ক্ষুধা নিবৃত্তি? তাই যদি
হবে কারণ না থাকলে তো উদ্দেশ্যই থাকে না। মানে আর কি তাঁর খিদে না পেলে তো আর
ক্ষুধা নিবৃত্তির প্রশ্নই আসে না। তবে?"
"কিম্বা ধর এই যে পটলার মা (ও বলতে ভুলে গেছি ওনার ছেলের ডাক নাম পটলা, ভাল
নাম... কি জানি মনে আসছে না, আর গিন্নির নাম তারাসুন্দরী) সেদিন নাইতে গিয়ে অমন জোর
বাথরুমে আছাড় খেলেন। এর কারণ বলতে পারি অনেক, যেমন পিছল বাথরুম, অন্যমনস্কতা
ইত্যাদি। কিন্তু এর উদ্দেশ্য কি হতে পারে? কিছুই না।
কিম্বা ধর এই যে পুঁটি (ওনাদের পোষ্য বেড়াল) বছর বছর বাচ্চা
বিয়োচ্ছে। এর কারণ না হয় প্রাকৃতিক, কিন্তু উদ্দেশ্য? আহা পুঁটি তো আর ডাক্তার
ইঞ্জিনিয়ার করবে বলে বাচ্চা দেয় না। কিম্বা ধর...." আরো কি ভাবতে যাচ্ছিলেন
হঠাৎ কিসের আওয়াজে ঘোর কাটল, পুঁটি কাঁদছে?
না না, সম্বিৎ ফিরতে দেখেন পুঁটির মা থুড়ি পটলার মা চামচ দিয়ে তার মুখ থেকে মুড়ি
বার করছেন, পটলা মাথার কাছে টেবিল ফ্যান ধরে দাঁড়িয়ে। গিন্নি কাঁদছেন আর পটলা
কাঁদব কাঁদব করছে, ফ্যান সামলাতে গিয়ে আর কান্নায় মনটা আনতে পারছে না।
এরপর রোজকার মত তারাদেবীর প্রলাপ, পটলার কম্পিউটার গেমের আর পুঁটির
রান্না ঘরে ঢোকার আধিক্য, আর পাড়ার লোকেদের সকৌতুক সমবেদনা, "আবার বুঝি
ভাবছেন উনি! এবার কি ভাবছেন পিসিমা / মাসিমা / কাকিমা / বৌদি / বৌমা..."
ইত্যাদি।
যা হোক দুদিন বাড়াবাড়ি কিছু হল না। তৃতীয়দিন কান্তবাবু অফিস
যাচ্ছেন। ট্রেনে বেজায় ভিড়। আবার চোরা অম্বলের মত সেই চিন্তা দুবার ঢেকুর তুলল
মাথায়। ব্যাস আর পায় কে? ট্রেন ছুটলো বাইরে, তিনি ছুটলেন ভিতরে। তিনি ভাবতে লাগলেন-
"এটা বোঝা গেছে মানুষ উদ্দেশ্য ছাড়া কাজ করতে পারে না। কিন্ত
এই যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, এর কি উদ্দেশ্য হতে পারে? এই যে জন্ম মৃত্যু, আগে এসে পরে
যাওয়া বা পরে এসে আগে যাওয়া। হ্যাঁ তো। ফুলমণি যায় নি? তিন বছরের ফুটফুটে মেয়ে
তাঁর, পটলার পরেই হয়েছিল। তাদের কোল মুছে যায় নি! কি উদ্দেশ্য ছিল তার আসার?
যাওয়ার কারণ তো ছিল তার রক্তে, ক্যানসার!
যাক সে কথা! কিন্তু কি উদ্দেশ্য এই এতবড় কর্মকান্ডের? জগতের
কারণগুলোর কত ব্যাখা বিজ্ঞানীদের কাছে। কিন্তু জানতে চাও, কেন? অমনি বলবে, এটা কে
রে? কেন এই অণু-পরমাণু জ্যোতিষ্কের এই বিরাট মেলা, অক্লান্ত ঘুরে মরা? কেন সময়?
কেন অনন্ত? কেন অসীম?.." আর মনে নেই কান্তবাবুর। জ্ঞান ফিরতে দেখেন পটলা তাঁর
মুখের দিকে চেয়ে বসে আছে। খোঁজ নিয়ে জানলেন গিন্নী গেছেন ব্যারাকপুরে কোন বড়
নার্ভের ডাক্তারের কাছে নাম লেখাতে। আরো শুনলেন তিনি নাকি ট্রেনে "কেন কেন"
বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। বন্ধুরা বাড়ি দিয়ে যায়।
সব বলার পর পটলা জানতে চাইল, "কি কেন বাবা?" তিনি চুপ
করে পাখার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মাথাটা ফাঁকা। পাখাটা ঘুরছে। তাঁর দু'চোখ বেয়ে জল
পড়ল। তা দেখে পটলার চোখ ভিজে এল, সে জানে তার বাবা পাগল না। লোকে যা ভাবতে পারে না
তার বাবা তা পারে। সে বাবাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল।
এর পরের ঘটনা মাসখানেক পর। ডাক্তার বেড়াতে বলেছেন। তাই তাঁরা পুরী
এসেছেন দুদিন হল। আরো থাকবেন ক'দিন। কান্তবাবু সেদিনের পর থেকে কথা বলেন না।
চারিদিক তাকালেই তাঁর মনে হয় - কেন?
সেদিন বিকালে তিনি বসে আছেন নীলাচলের সামনে। অজস্র লোক স্নান
করছেন। কি একটা উৎসব আজ। তারাসুন্দরীও কি একটা ভাবছেন পাশে বসে। পটলা ঝিনুক
কুড়াচ্ছে। তাদের এদিকটা বেশ ফাঁকা। হঠাৎ শোনেন ডুকরে কান্নার আওয়াজ। চমকে ফিরে
দেখেন কান্তবাবু কাঁদছেন। তিনি তাকাতেই কান্তবাবু তাঁর হাত দুটো চেপে ধরে ঝরঝর করে
কেঁদে ফেললেন। তারাদেবী পুরো থতমত। কান্তবাবু বলে চললেন, "এই সহজ কথাটা বুঝতে
পারিনি গিন্নী! কোনো কিছুরই কোন উদ্দেশ্য নেই। অনন্ত কি কিছুর অপেক্ষা করেন
গিন্নী! তা হলে আর তিনি অনন্ত কেন? ফুলমণি আসেও নি, যায়ও নি। তার আসা-যাওয়া আমাদের
এই ছোট সংসারে গিন্নী, তেনার সংসারে না গো। পটলাকে দেখ কেমন ঝিনুক কুড়াচ্ছে, আর
সামনে দেখ কত ঢেউ আসছে আর যাচ্ছে। এর উদ্দেশ্য কিছুই না। কারণ? আনন্দ। ওই লোকগুলোর
দিকে দেখ কত দুর থেকে কত কষ্ট করে ছুটে এসেছে, সে তো এই অনন্তকে ছোঁবে বলেই।
আকাশকে তুমি জানলা থেকেই দেখ আর খোলা মাঠে দাঁড়িয়েই দেখ - চোখ তো সেই নীলকে ছোঁবেই
গিন্নী...", আরো কি সব বলে যাচ্ছিলেন কান্তবাবু তারাসুন্দরীর আর কর্ণগোচর
হচ্ছিল না। তাঁরও দু'চোখ বেয়ে জলের ধারা। তাতে নীলাচলের প্রতিবিম্ব। তিনি কি
বুঝলেন তা তিনিই জানেন। শুধু বললেন, ওঠো; আর পটলাকে বললেন, "বাবা মন্দিরে যাব
চলো।"
No comments:
Post a Comment