টুপ টুপ করে সারা জঙ্গল জুড়ে যেন ভালোবাসা ঝরে পড়ছে। ভোরে উঠে সরু নদীর পাড়ে বসে থাকা
কান্তাচার্য্য’র আজ মনটা প্রসন্ন। এমন প্রসন্ন মন কদাচিৎ হয়। এ যেন বৈশাখের ভোরের ঠান্ডা
হাওয়ার প্রসন্নতা। কান্তাচার্য্য গাইছেন, “বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া...।” কান্তাচার্য্য
একলা বেড়াতে এসেছেন।
আকাশটা মেঘলা। কান্তা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
আমায় এমন মেঘের মত ভালোবাসা দাও, আমার মনের সমস্ত আকাশ জুড়ে থাকুক এমন একটা ভালোবাসা।
আমার বাকি ভালোবাসাগুলো সে ভালোবাসায় আশ্রয় পাক!
কান্তাচার্য্য নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে। স্বচ্ছ
জল। নদীর বুকের মধ্যে পাথরের ছোটো-বড় নুড়ি, মাছেদের চলাচল – সব দেখা যাচ্ছে। কান্তাচার্য্য
বলল, আমার বুকের মধ্যে এমন স্বচ্ছ চেতনা নদী হোক। সব কিছু যেন স্পষ্ট দেখি – নিজেকে,
অন্যকে...
কান্তাচার্য্য’র বুকে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের
জট ছিল। কান্তা মনটাকে এলোপাথাড়ি খুঁজে ফেলল। কোত্থাও পেল না। ভালোবাসা জন্মালে প্রশ্ন
জন্মায় না। ভালোবাসা মানে গলে যাওয়া। ভালোবাসা মানে ফুলের উপর প্রজাপতি এসে বসা – পরাগসংযোগ
হওয়া। ভালোবাসা মানে তুলোর মত উড়ে যাওয়া – এমন হালকা হওয়া। কান্তা ক্লান্ত হল না আজ।
নইলে সারাটাদিন মনের সাথে লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে যায়। সেও ভালো লাগে। সবার লড়াই কি আর
বাইরের জগতে, বাইরের শত্রুর সাথে? নিজের মধ্যে যে কত বৈরিতা! আত্মবৈরিতা – নিজের সাথে
নিজের শত্রুতা।
কান্তা শর্ট প্যান্টটা শুধু পরে, বাকি জামাপ্যান্ট
পাড়ে রেখে নদীতে নেমে গেল। নদীর মধ্যে গিয়ে বসল। কি স্রোত! কি টান! কান্তা’র নাভি অবধি
ডুবে নদীতে। কান্তা পদ্মাসনে বসে। “ওগো আমায় ভালোবাসা দাও। ওগো আমায় শুদ্ধ ভালোবাসা
দাও। যে ভালোবাসা শুদ্ধের প্রতি সেই তো শুদ্ধ ভালোবাসা। যেমন আগুনকে ভালোবেসে মানুষ
আগুন হয়, জলকে ভালোবেসে মানুষ জল হয়, তেমন শুদ্ধকে ভালোবেসে মানুষ শুদ্ধ হয়। ওগো শুদ্ধ
স্নিগ্ধ মানুষেরা, আমার ভালোবাসা নাও। আমার সমস্ত ভালোবাসা তোমাদের দিকে যাক। যে শুদ্ধকে
ভালোবেসে তোমরা শুদ্ধ, সেই বুদ্ধ-মুক্ত-শুদ্ধ’র দিকে আমার প্রাণের টান হোক। আমি নানা
থেকে একের দিকে এগোই - যেমন এই নদী, যেমন এই গ্রহপুঞ্জ, যেমন মাতৃগর্ভে এক অমরার টান
– ওগো আমায় একের দিকে আনো, ওগো আমার সমস্ত সেই একের দিকে যাক। আমার মনে অভিসারী টান
লাগুক। আমার মন কি কেবলই অপসারী হয়ে নিজেকে ক্ষয় করবে?
কান্তা স্নান সেরে পাড়ে এসে বসল। কাকে ভয় সংসারে?
ভয় শুধু নিজের প্রবৃত্তিকে। নির্বোধ প্রবৃত্তিকে। “লক্ষ্য-শূন্য লক্ষ বাসনা ছুটিছে
গভীর আঁধারে, / জানি না কখন ডুবে যাবে কোন্ / অকুল-গরল-পাথারে! / প্রভু বিশ্ব-বিপদহন্তা,
/ তুমি দাঁড়াও, রুধিয়া পন্থা; / তব, শ্রীচরণ তলে নিয়ে এসো, মোর / মত্ত-বাসনা গুছায়ে!
/ মলিন মর্ম মুছায়ে”...
কান্তার চোখে জল। কান্তার মায়ের চরণযুগলের কথা
মনে পড়ছে। ডানপায়ের মধ্যমাতে একটা আঙট। রূপোর আঙট। মা’কে শেষ কবে প্রণাম করেছিল কান্তা?
শেষ দাহের সময়। মায়ের শরীরটা যখন বৈদ্যুতিক চুল্লীর সামনে রাখা।
বৃষ্টি শুরু হল। কান্তা ভিজছে। তার পাশে রাখা
জামাকাপড় ভিজছে। কান্তা উঠতে চাইছে না। উঠে কি হবে? সব রাস্তা মিশে মাঠ হয়ে গেছে। কোথায়
যাবে? কার কাছে যাবে? শুধু শরীর চালাতে যেটুকুর খোরাকি। মনের খোরকি কি হাটের জিনিস?
মানুষ সারাটা জীবন কতক্ষণ আর শরীরে বাঁচে? বাঁচে তো মনে। “কেন রে তোর দু হাত পাতা--
/ দান তো না চাই, চাই যে দাতা--”।
ভয় বলো, কাম বলো, সুখ বলো, দুঃখ বলো, শান্তি
বলো, উদ্বেগ বলো – সবই এই মনের খেলা। ভালোবাসাটুকু নয়। মন ভালোবাসা বোঝে না। ভালোবাসা
মানে চৈতন্য। মন যদি ভালোবাসার দাস হয়, তবে তো সবই সোজা – সত্য বলো, সুপথে চলো। তা
তো না, মন চায় ভালোবাসার উপর প্রভুত্ব। চোরাগোপ্তা শরীরী সুখের উমেদারি। ভালোবাসাকে
বশ করতে চায় – ক্ষ্যাপা মন।
কান্তার চোখ বন্ধ। ঠোঁটের কোণায় হাসির ছটা। আকাশ
জুড়ে মেঘ। মাটি ভাসছে অঝোর ধারায়। পাহাড়ি নদী কলকল করতে করতে ছুটছে। সব দাস, ভালোবাসার
দাস। দাস না হতে পারলে সব নষ্ট – মহতী বিনষ্টি। কান্তা গান গাইছে – “নিত্য তোমার যে
ফুল ফোটে ফুলবনে...।”
No comments:
Post a Comment