ঈশ্বর বলো, আল্লাহ্ বলো - তাঁর বাগানে ঘুরে এলাম।
মনসুর ফকিরের আশ্রম। করিমপুরের কাছে, গোরভাঙা গ্রাম। দুপুর আড়াইটে নাগাদ আশ্রমে
পৌঁছালাম। শান্ত পরিবেশ। একটা মাজার। তার সামনে গাছকে বেড় দিয়ে দিয়ে বসার জায়গা।
এপাশ ওপাশ পুকুর। আশেপাশে সরল সহজ গ্রামবাসীদের আনাগোনা।
ফকির আসলেন। দীর্ঘাঙ্গ, শ্বেতবর্ণ সুঠাম দেহ। বয়েস পঁয়ষট্টির কাছাকাছি। সাদা
দাড়িগোঁফের মধ্যে দিয়ে ঝিলিক দিয়ে গেল খুব পরিচিত একজোড়া প্রাণ ঠাণ্ডা করা দৃষ্টি।
আর মনমোহন হাসি।
মাজারে বসেই যখন শুনলেন আমরা আসার পথে খেয়ে এসেছি, আর কিছুটা দূরে নিজারপুরে লজে
থাকব মনস্থ করেছি - ক্ষুণ্ণ হলেন। বললেন, এই আশ্রমে না থাকলে আমরা গানও শুনাই না,
কথাও বলি না। মুখে কপট রাগ। চোখে দুষ্টুমির হাসি। আমরা ন'জন বন্ধু এমনটাই আশা
করেছিলাম। রাজি রাজি রাজি।
মাজারে দোতারা বেজে উঠল ওর প্রসাদী হাতের আঙুলে। চারদিকের শান্ত পরিবেশ রসে ডুবতে
শুরু করল - লালনের সম্প্রীতির গানে। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ সব অমূলক, জাত অজাতের
বিচার মনের ভ্রান্তি - এ সব পরম বিশ্বাসের সাথে প্রতি শ্বাসের সাথে উচ্চারিত, গীত
হতে থাকল।
সুর চুঁইয়ে চুঁইয়ে বুকের পাত্রে ঢুকতে লাগল। পাশে ওনার পরিবারের লোকজনের সঙ্গত।
গানের সঙ্গত। বাজনার সঙ্গত তাদের হাতেই। কলকাতা থেকে আগত ওনার কন্যাসমা আরেক
অন্তঃবাউল Sahana।
সে আমাদের অনভিজ্ঞ বন্ধুদের লোকাল গার্জেন হয়ে উঠল অচিরেই। যেন খুব চিনি আমরা একে
অপরকে।
ফকিরজীর বৌমার গান শুনলাম। এগুলোই তো গান। যা বুকের কেন্দ্র থেকে গভীরতম শ্বাসের
সাথে, আবেগের সাথে, বিশ্বাসের সাথে বুকে এসে বেঁধে। বিঁধল। তিনিও গাইলেন লালন,
জগন্নাথকে দেখে এসো, দেখো জাত রাখো কি করে?.....
গান চলল। গল্প চলল। কে অপরিচিত? কারা অপরিচিত? তৃষ্ণার্তের কাছে তৃষ্ণার জলের কোনো
পরিচয়পত্র লাগে কি? আর মহাকাশে আপন-পর বেড়া দেওয়া যায় কি? যায় না। এই মাজারেও, এই
লালনেও সেই এক কথা। প্রেম সাগরে নামল ক্ষ্যাপার দল, সাথে কাণ্ডারী জগৎক্ষ্যাপার মহাক্ষ্যাপা
- মনসুর ফকির।
আমন্ত্রণ আসল। ভবা পাগলার অনুষ্ঠানে গাইতে যাবেন ফকির - সপার্ষদ। সাথে চলার
আমন্ত্রণ। যাব বইকি? ঘরের বাইরে পা রেখেছি যখন আর হিসাব কেন? হিসাব তো অভাবের
জগতের কথা। ভাবের জগতে একটাই কথা - প্রেম। কথায় প্রেম। চলায় প্রেম। ঠাট্টায় প্রেম।
শাসনে প্রেম। তাকানোয় প্রেম। চোখ মুদে ভাব দরিয়ায় নাও ভাসানো প্রেম। ভাসবে চলো।
সত্য বলো, সুপথে চলো।
বললেন, বাবা ধর্ম এক - মানুষরে ভালোবাসা। সাধন এক - সব চালাকি ছাড়ো। নিজেকে না
জানলে, তাঁকে জানা যায় না। নিজেকে জানো। সংযত হও। শরীর, মন সংযত হোক। কেউ হিন্দু
মুসলিম খ্রীষ্টান হয়ে জন্মায় না বাবা। মানুষই করে ভেদ। ভেদ ভোলো। এ ভ্রম। ভারতবর্ষ
এক মহান দেশ। এ দেশ দাঙ্গা হাঙ্গামা করার জায়গা না। ভালোবাসো, মানুষই সব।
মানুষের সাগরে এসে পড়লাম। ভবা পাগলার গানের অনুষ্ঠান। শুরু হল গান আটটায়। চলল
এগারোটা পর্যন্ত। ফকিরের সাথে তার দলবল। এতগুলো মানুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা ভেসে গেল।
গান হল। নাচ হল। এক একটা পদ একটা ফুলের মত বিকশিত হতে লাগল। মানুষের উৎসাহ,
উদ্দীপনা অনেক জলসায় দেখেছি। এখানে অন্যরকম। একটা সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার কাছে
নিজেকে খুব ভারবহ মনে হতে লাগল। যেন কি বিস্তর পার্থক্য। সে পার্থক্য নিমেষে ভেসে
গেল, একজন বর্ষীয়ান মহিলা শিল্পীর আন্তরিকতার ছোঁয়ায়। যখন শুনলেন আমরা ফকিরবাবার
সাথে এসেছি, আমার হাতে হাত রেখে বললেন, কাল আশ্রমে থাকবে তোমরা? তবে যাব।
কে আমরা? এ কিরকম আত্মীয়তা, যে এক ছোঁয়াতেই নিজেকে তুলোর মত হাল্কা করে ধুলোর উপর
নামিয়ে আনে? জানি না। শুধু অপরাধীর মত অনুভবে বললাম, কাল যে ভোরেই বেরতে হবে?
সেই তো মন। সে কপাল করে কি তোমায় গড়েছি? কিছুটা গড়েছি আমি তোমায়, আর কিছুটা গড়ছ
তুমি আমায়। এই খেলাতেই তো আটকে। সব মন একের দরবারে পৌঁছাতে পারলাম কই? তার কিছুটা
তেপান্তরে, কিছুটা মহাসাগরে, আবার কিছুটা পাতালে নিষিদ্ধ রসে। পা তুললেই হল? ফেলবে
কোথায়? রাখবে কোথায়?
গানের শেষে সামনের বাড়ির উঠানে নৈশ আহারের বন্দোবস্ত। মাটির মানুষের, মাটির
আতিথেয়তায় সব মধুর। এই তো চারদিকে কেমন সব মানুষ- এরা চামড়ার দাম দেখে না। দেখে
প্রাণের উষ্ণতাটায় ভাটা আছে কিনা। না থাকলে চাগিয়ে দেবে। আর একান্ত তোমায় আপন করতে
না পারলে, নিঃশব্দে মেনে নেবে। ভাববে, দোষটা তারই - এতটা নীচে এত জানা মানুষ নামতে
পারে? হায় রে শিক্ষার সাম্যতা!
মাজারে আসলাম রাত বারোটার পর। বাবা এসেই ধরলেন গান। বসল সেই ভাঙা
আসরের উপসংহার। এই তো নাকি আসল গান, বাবার ভাষায়। কারণ এ গান তাঁর মুরশিদ আজাহারের
জন্য। যিনি এই তো শায়িত, এ বেদীতলে। আবার যিনি জীবিত মনসুর ফকিরের সব তন্ত্রী
জুড়ে।
গভীর রাত। দোতারাতে বাজল সুর। করুণ সুরে রাত্রি ফুঁপিয়ে উঠল। কি যেন একটা না
পাওয়া, বুকের মধ্যে মোচড় দিল। কাকে যেন না খোঁজার ব্যাথা। ফকির বললেন, এই তো সময়
সাধনের বাবা। যা সাধতে চাও, এই হল সময়। নিজেকে নিয়ে নিজেতে ডোবো। বাইরেকে বাইরেই
ছাড়ো। ভিতরের খবর বাইরে মেলে কি?
চোখের জলে সুরের নদী নামল বুকের প্রান্তরে। দু'কুল ছাপাল। অদূরে বাবার নিজের জন্য
আগাম তৈরি অন্তিম বিশ্রামের স্থান। সেখানেও জানানো হয়েছে আমন্ত্রণ।
ভোররাতে ঘুম ভাঙল। ফকির কই? ওই যে দেখো, এক আকাশ তারার নীচে একা ফকির। যাও,
জিজ্ঞাসা করো কিছু।
এই তো উপযুক্ত সময়। গুটিগুটি পায়ে সামনে এলাম। রাত্রির সব অন্ধকার বিলীন। আমার
চোখের সামনে এ কি আলো! এতো আলো! দু'চোখ মুদে আলো মেখে আসলাম। বুকের কোণা দিয়ে চুঁইয়ে
চুঁইয়ে আলো স্নান করালো সারা সত্তাকে। মিলিয়ে গেলাম। হারিয়ে গেলাম। বললাম, ভয় করে
না ফকির? এই এতো রাতে, একা? বললেন, ভয় তো আত্মার গো, পরামাত্মার ভয় কি?
সেই তো। ঘড়ার জলেরই যত ভয়। শুকিয়ে যাবার, গড়িয়ে পড়ার। সাগরের জলের কি আর সে ভয়
আছে!
গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। ফিরতে হবে। কান্না পাচ্ছে। ফকিরের
পায়ে মাথা রাখতে গিয়ে পারলাম না। ফকিরের দুটো হাত বুকে জড়িয়ে নিল। মাথায় পেলাম
আশিষ চুম্বন। গাড়িতে উঠলাম। ফকির দাঁড়িয়ে জোড়হাতে। চোখের কোল ভিজছে। ভিজুক। এমন
কান্নার সৌভাগ্য কদিন আসে! ফকিরের দরজায় কি একটা যেন ফেলে এলাম। আমি একা না।
সব্বাই ফেলে এসেছি। তাকে আনতেই আবার যেতে হবে ঈশ্বরের বাগানে। আল্লাহ্র বাগানে।
নইলে বাঁচব কি করে?
( ছবিগুলো
তুলেছে Debasish.
আরো বলে রাখি। অনেক গান ভিডিও করা হয়েছে। কিছুটা পরিমার্জন করে ইউটিউবে দেওয়া হবে।
কবে বলতে পারছি না। তবে খুব তাড়াতাড়ি দেওয়ারই চেষ্টা করা হবে। অমৃত একা ভোগে আনন্দ
নেই। সব্বাই কে চাই যে!)
বাঙলাদেশ থেকে উনার আশ্রমে যেতে চাই। কিভাবে যাব?
ReplyDelete