চারদিকে
আলোকসজ্জা। সন্ধ্যে হয়েছে বেশ খানিকক্ষণ হল। রাস্তায় হাঁটছি। কিছু একটা চিন্তা
মাথার মধ্যে নিজের অজান্তেই চলছে। হঠাৎ কানে এলো একটা মহিলা কণ্ঠস্বর, অনুরাধা
পাড়োয়াল, প্যাণ্ডেলে বাজছে, 'সময় তো থাকবে না গো মা'...
চিন্তায় ছেদ পড়ল। চিন্তার চাদর গা থেকে খুলে বাইরের জগতে চেতনা
ফিরল। শুনলাম কোথাও বাজছে পান্নালালের কণ্ঠস্বর - 'আমি সব
ছেড়ে মা ধরব তোমার রাঙা চরণ দুটি'। আরো এগোলাম। কোথাও শ্রীকান্ত আচার্য, কোথাও কুমার
শানু, কোথাও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য'র কণ্ঠস্বরে বেজে চলেছে
শ্যামাসঙ্গীত। আজ হঠাৎ শ্যামাসঙ্গীতের মত করে আমার চেতনায় গানগুলো বাজল না। একটাই
শব্দ মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করে উঠল মশালের মত - 'মা'।
মনের মধ্যে মন
জাগল। আশেপাশের ভিড়ে সব মানুষকে হঠাৎ-ই মনে হল - কেউ একা, অসহায় নইতো।
আমাদের সবার তো একজন মা আছেন! না, ঠিক বললাম না, আমাদের সবার
মধ্যেই কোথাও একটা মায়ের জন্য আকুতি তো আছেই, না!
নেই? আছে।
সারাদিনের নানান পরিশ্রম, আঘাত, উপেক্ষা, অপমান, বঞ্চনা, দুঃখ, লাঞ্ছনা সইতে
সইতে যখন মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে, তখন একটা কোথাও সান্ত্বনা খুঁজি, একটু স্নেহ
পাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মনে হয় এই ঘন অন্ধকারে, এই পাতালগামী
হতাশার অন্ধকারে কেউ যদি আমার মাথায় একটু হাত রাখত, বলত এই তো আমি
আছি। কোনো তুচ্ছ, হীন যাদুমন্ত্রে না, পবিত্র
স্নেহের স্পর্শে আমার অবসাদগ্রস্থ আত্মাকে আবার পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারত- সে কে হত? সেই মা। পরম
সান্ত্বনা, পরম বিশ্রাম, পরম আশ্বাস
যেখানে - মা সেখানে।
পুরুষের
বাহুবল আছে, বিপদ-ঝুঁকিপূর্ণ পথে ঝাঁপিয়ে পড়ার দুঃসাহস আছে। আরো
নানান জায়গায় সে অগ্রগণ্য প্রকৃতির বরে। কিন্তু এসব উগ্রসুখের শেষে, প্রতিদিনের
শান্ত পরিমিত নিত্য জীবনযাত্রায় সে নিতান্তই দুর্বল। নিজেকে সুষ্ঠুরূপে পরিচালিত
করার ক্ষমতা প্রকৃতি তাকে দেয়নি। তার হাত ধরার প্রয়োজন হয় একজন নারীকে। যেরূপেই
হোক। সে তার শারীরিক চাহিদা, মানসিক
চাহিদার শেষে তার স্ত্রীর কাছে যেটা চায় সেটা আশ্রয়। তাকে ধারণ করবার আকুতি। নিজেকে
সঁপে দেওয়ার ব্যকুলতা। সব পুরুষের গভীর অন্তরালে একটা মায়ের জন্য চাহিদা থাকে।
কারণ এ ধারণক্ষমতা পুরুষের নেই যে, তাই
পৃথিবীও হয়ে ওঠে Mother Earth. আর প্রকৃতি তো মা-ই। তবে পুরুষের
অসুবিধাটা কোথায় এ শক্তিকে স্বীকার করতে? আছে
তো। মহিষাসুরের বংশ কি শেষ হল নাকি? হয়নি।
তাদের কথা আলাদা। আর যারা ভোলা মহেশ্বরের মত জগন্মাতার কাছে অহং বিসর্জন দিতে
অপরাগ অথচ ঠিক মহিষাসুর গোত্রীয় নন (যাদের
সংখ্যাই অধিক) তারা কি করবে? সে-ও মানবে। তবে নিজের পৌরুষের ঠুনকো
গর্বকে বাঁচিয়ে রেখে। যেন সে তার হাতে হাত রাখা নারীটিকে বলতে চায় - “তুমি বুঝবে আমি কত অসম্পূর্ণ, দুর্বল তোমায় ছাড়া, কিন্তু কখনোই তা আমায় বুঝতে দেবে না যে
তুমি বুঝেছো। আমার ইগোতে লাগবে। জানোই তো তোমার আছে পুরো সংসারটার ভিতর-বাইরে
সত্যিকারের, আর আমার আছে শুধুই
আমার পৌরুষের এই সাজানো বর্ম, জগতকে
তাক লাগানো ছাড়া যার কোনো কাজ নেই; আর
তাও সে করে নিজের ভিতর নিজেকে সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ জেনেই।”
খুব ক্লীশে
শোনালেও, তাই যখন কোনো পুরুষ
নারীজাতির অপমান করে তখন সে নিজের অস্তিত্বকেই বিপন্নতার মুখে ঠেলে দেয়। আর এদের
কারোরই অন্তিম পরিণাম সুস্থ মর্যাদাযোগ্য থাকে না আর। এ কথা কোনো ব্যক্তি পুরুষের
ক্ষেত্রেও যেমন সত্য ঠিক তেমন এক জাতির ক্ষেত্রেও সত্য। স্মরণে আসছে বিবেকানন্দের
সেই পর্যবেক্ষণ, ভারতের অবনতির
দুটো কারণ - এক, গরীবদের
পদদলিত করা আর দুই, নারীজাতিকে
অসম্মান করা।
খুব মধ্যযুগীয়
কথা শোনাচ্ছে? এ মধ্যযুগীয় না, এ চিরন্তন সত্য। 'মা' - আমাদের সৃষ্টির প্রথম পরিচয়। 'মা'-ই আমাদের সারাটা জীবনের সুষ্ঠু
পরিচালিকা শক্তি। দেখা যায়, যে
পরিবারের মা সম্মান পান, যে
পরিবারের মায়ের কথা যথাযোগ্য গুরুত্ব পায় সে পরিবারের শৃঙ্খলা তত সঠিক হয়, মাত্রানুগ হয়, মাধুর্যমণ্ডিত হয়। তবে কি সব নারীর
মধ্যেই এই শক্তি, এই ক্ষমতা বর্তমান? আমার বিশ্বাস কম-বেশি অবশ্যই বর্তমান।
তবে কোনো নারী যদি শুধু নিজের লাস্যতাকেই উপজীব্য করে বাঁচতে চান তার কথা আলাদা।
তার পরিণাম সমষ্টির মূল ধারার পরিণাম নয়। কোথাও তো একটা অসম্পূর্ণতা থাকেই। সন্তান
গর্ভে ধারণ করেই যে সে ধর্ম পালিত হয় তা তো নয়, সংসারে
স্নেহের ক্ষুধা অপরিসীম। একজন মাদার টেরেসা, একজন
মা সারদা, একজন নিবেদিতা না, বহু মাতৃত্ব সীমা ভাসিয়ে আজও বইছে বলেই
সংসারটা এখনও টিকে আছে। সে স্পর্শ পাইনি এ কথা বলা পাপ, অকৃতজ্ঞতা হবে!
কথাটাকে আরো
এগোনো যেতে পারে। 'মা' কি তবে শুধুই নারী জাতি? না। 'লাগে
রহো মুন্নাভাই' এর একটি দৃশ্যের
কথা মনে করাচ্ছি। যখন প্রধান চরিত্র মুন্নাভাই (সঞ্জয়
দত্ত) তার বন্ধু সার্কিটের (আরশাদ ওয়ার্শি) প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা জানাতে, অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে কাঁদছে, আর বলছে, 'আমি যখন খুব অসুস্থ হয়ে
হাসপাতালে ভরতি ছিলাম তুমি তখন গান গেয়ে, মাথায়
হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে, ঠিক মায়ের
মত!'
এই কথাটাই
বলতে চাইছিলাম - মায়ের মতো। একজন বন্ধু, প্রতিবেশি, সঙ্গী যে কেউ যখন আমার পাশে এসে তার
স্নেহের হাত বাড়িয়ে দেয় কোনো যৌন আকর্ষণ, স্বার্থগন্ধ
ছাড়াই, তখনই তা মায়ের স্নেহের মত
হতে বাধ্য (এখানে একটা কথা বারবার
বলতে ইচ্ছে করে, স্বামী-স্ত্রী
সম্পর্কটা কোনো মতেই শুধু যৌন আকর্ষণ হতে পারে না। আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত
আছে 'সহধর্মিনী'। জীবনসঙ্গিনী
ইত্যাদি শব্দ থেকে এই শব্দটার তাৎপর্য আরো গভীর বলে আমার অন্তত মনে হয়।)।
তাই মনে হয় এই 'মা' শব্দটার
উপর যদি সত্যিই আমাদের শ্রদ্ধা জন্মায়, যেভাবে
বিভিন্ন মাতৃসাধক তাদের নানান গীতাবলিতে, নানান
পদে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সাথে এইভাবকে একাত্ম করে নেওয়ার পথ দেখিয়েছেন তবে আমরা
আরেকটু বোধহয় বেশি অগ্রসর হতে পারতাম। তিনি কালী হন, দূর্গা হন, মেরী হন, গর্ভধারিনী হন, স্ত্রী হন, বন্ধু হন, যেই হন - অত্যন্ত
শক্তিশালী ক্ষমতাকে স্বীকার করতেই হয়, নিজের
মধ্যেও করতে হয়। না হলে বুদ্ধ কখনোই বলতে পারতেন না “মা তাঁর একটি মাত্র পুত্রকে
যেরকম ভালোবাসেন, সেইরকম ভালোবাসা
দিয়ে সমস্ত জীবকে আগলে রাখবে।” কিম্বা চণ্ডী গাইতে পারেন - "যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ
সংস্থিতা। / নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।" মাতৃত্ব ইস্ট্রোজেন বা প্রজেস্টেরণ
নির্ভর নয়, অথবা টেস্টোস্টেরণ
বিরোধীও নয়।
আজকের রাতটা
এই মাতৃত্বকে বিশ্বের নিরিখে দেখার রাত। একটা কুকুর বেড়ালের মা'ও যেমন তার
সন্তানকে রক্ষা করে স্নেহের জোরে, একটা
পাখি তার নীড়ে যেমন তার শাবকের জন্য মুখে করে খাবার নিয়ে আসে, একজন মানব মা তার দুর্বলতম সন্তানকে (প্রকৃতির কোলে দুর্বলতম হয়ে জন্মায়
বোধহয় মানব সন্তান। মা তাকে কোলে না করলে তার স্তনপান করে বাঁচাটাও অসাধ্য তার
পক্ষে, এমনই মাতৃস্নেহের উপর নির্ভরশীলতা
তার) যেমন করে কোলে নিয়ে স্তন পান
করান - এ সবের মধ্যে একটাই শব্দ আছে - মা।
এই শক্তিকে অসম্মান করলে নিজের সর্বনাশ।
ছোটবেলা থেকে
বড়বেলা অবধি নিজের মাকেই পরম আশ্রয় বলে জেনেছিলুম। পবিত্রতা কত হালকা করে মাকে
জড়িয়েই বুঝেছি বড়বেলা পর্যন্তও। যত দিন গেছে, বুঝেছি
মাতৃত্ব একটা এমন আলো সে যাতেই প্রতিফলিত হোক না কেন সে একই মাতৃত্বের প্রকাশ হবে।
অনেক মা বলে কিছু হয় না, মা একজনই।
সব দিকে শুধু তার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। তাই মাকে শেষ যাত্রায় এগিয়ে দিয়ে যখন
ফিরছিলাম, দেখেছিলাম একটা বেড়াল
তার বাচ্চাকে মুখে করে রাস্তা পার হচ্ছে। তৎক্ষণাৎ মনে হল মাকে হারালাম কই? এই তো মা। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এক
বৃদ্ধকে কাঁদতে দেখেছিলাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, তখন
নাটমন্দিরে গান হচ্ছিল, “মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে... মাকে মনে পড়ে আমার”...পাশে তার স্ত্রী
চুপ করে বসেছিলেন। তার মুখে অপরূপ গাম্ভীর্যতা। ভদ্রলোকের ডান হাতটা চেপে ধরে
আছেন। মনে ভাবলাম, উনি কাঁদছেন
কৃতজ্ঞতায় না যন্ত্রণায়? যন্ত্রণায়
কাঁদলে মানুষের মুখে এমন সারল্য আসে কি? আসে
না। বহু স্ত্রীকে বলতে শুনেছি, ‘ও যেন আমার আগেই যায়, ও নিজেকে সামলাতে পারবে না, চলতে পারবে না আমি আগে গেলে। বরং আমি
পারব।‘
আমি মনেপ্রাণে
বিশ্বাস করি, আমাকে মধ্যযুগীয়
বললেও বিশ্বাস করি, মেয়েদের জাত
মায়ের জাত। তার অসম্মান করার অর্থ নিজের সব্বনাশকে ডেকে আনা। দক্ষিণেশ্বরের সেই
পাগলা মানুষটাও আজ এই বাণীই শুনিয়ে সারা বিশ্বকে জয় করেছেন, তোমাদের একজন মা আছেন। অসহায়তা যত গভীর
হবে, ডাক যত আকুল হবে, সে মায়ের অস্তিত্ব ততই প্রকট হবে তোমার
কাছে। কাম না, অর্থ না - মানুষের
পরম চালিকাশক্তি, পরম অন্বেষণ হল
প্রেম। যার চূড়ান্ত প্রকাশ হলেন 'মা'।
(ছবিঃ সুমন)

No comments:
Post a Comment