জানলাটা বহু পুরোনো ডিজাইনের, এরকম লোহার কাজ এখন খুব একটা দেখা যায়
না। তিনটে হাঁস জলে ভাসছে। লোহার ঢেউ, লোহার হাঁস। আমি যখন
ছোটো ছিলাম, আমার মনে হত আমারও এরকম একটা হাঁসওয়ালা জানলা থাকবে।
পরে অবশ্য সে ইচ্ছাও থাকল না, আর ডিজাইনটাও সেকেলে হয়ে গেল।
জানলার সেই লোহার হাঁসে মাথা রেখে তাকিয়ে
বৃদ্ধা, মারা গেছেন। বিকালের
আলোয় মুখটা এত জীবন্ত দেখাচ্ছিল যা সারাটা জীবন দেখায়নি।
রাস্তার পাশে বাড়ি। দোতলা। উপরে এক ভাড়াটে
পরিবার থাকে, নীচে আরেকটা ভাড়াটে
পরিবার। বৃদ্ধা এই একটা ঘর, একটা রান্নাঘর, আর বাথরুম নিয়ে বাড়ির পশ্চিম দিকটায় থাকতেন। রাস্তার দিকেই বড় জানলাটা।
সন্ধ্যে হব হব, জানলার সামনে থিক থিক করছে ভিড়। ঝিরঝির
বৃষ্টি পড়ছে। এর ছাতার জল ওর গায়ে লাগছে, এর ছাতার শিক ওর
ঘাড়ে খুঁচিয়ে যাচ্ছে, সেই নিয়ে বচসা হচ্ছে। ছাতার আড়ালে মৃত
বৃদ্ধার মুখটা দেখতে না পেলেও অনেকে বিরক্ত হচ্ছে। ক্লাবের ছেলেরা আঠারো কিলোমিটার
দূরে একটা ফুটবল ম্যাচ খেলতে গেছে। এবারের শিল্ডটা তাদের পেতেই হবে, পর পর চারবার হেরেছে ওরা গত চার বছরে। ওরা থাকলে এতক্ষণে দরজাটা খুলে ঠিক
ঢুকে পড়ত, ওনাকে বিছানায় শুইয়ে দিত। বিছানাটা জানলা দিয়ে
দেখা যাচ্ছে, নীল সাদা চেক চেক বেডশিট পাতা, টান টান। দুপুরে শুয়েছিলেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না, নাকি
সকালেই শেষবারের মত বিছানা ছেড়ে উঠেছেন।
মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল আবার। সাথে দমকা
হাওয়া। লোকজন হুড়মুড় করে দৌড়ালো। কেউ গাছের নীচে, কেউ পাশের রকে, কেউ দোকানের সামনে
দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়ানোর জায়গা নিয়েও বচসা হল। বৃদ্ধা একা জানলার গারদে মাথা রেখে,
ভাবলেশহীন মৃত মুখে তাকিয়ে রাস্তার দিকে, জলের
ঝাপটায় মুখটা ভিজছে। সাদা চুলগুলো উড়ছে, মুখে পড়ছে, যে চুলগুলো সকাল অবধিও মুখে পড়লে শীর্ণ নীল শিরা বের হওয়া হাতের আঙুল দিয়ে
সরিয়ে নিয়েছেন।
মুখটা অত্যন্ত সুন্দর। ফর্সা, বড় বড় চোখ, ঠোঁট
পানের রঙে লাল, কথা বললেই সুগন্ধী জর্দার গন্ধ বেরোতো। ওনার
স্বামী নিরুদ্দেশ আজ প্রায় কুড়ি বছর। বাজার করতে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে আর ফেরেননি এক
সপ্তমীর ভোরে। সেদিন সকালেই ইনি একটা নতুন শাড়ি ভেঙে পরেছিলেন, তাঁতের লতাপাতা আঁকা লাল শাড়ি, উনি বাজার থেকে ফিরলে
পাড়ার মণ্ডপে পূজো দিতে যাবেন বলে। ফেরেননি, উনি শাড়িটা
ছাড়েন নবমীর দিন রাতে, আর কোনোদিন পরেননি, তুলে রেখেছিলেন, এই শাড়িটাতেই উনি শেষবারের মত এনাকে
দেখে গিয়েছিলেন বলে। ওনার শ্বশুর এই বাড়িটা বউমার নামে করে মারা যান কোনো এক শীতের
সকালে। সেই থেকে এই মানুষটা একা। একা একাই বৃদ্ধা হলেন, জানলার
ধারে বাঁচতে বাঁচতে, অপেক্ষা করতে করতে।
টিভিটা খোলা। প্রতিদিনের সঙ্গী সন্ধ্যের
সিরিয়ালগুলো একটার পর একটা হয়ে যাচ্ছে। ভল্যুইমটা একটু বেশি, কানে কম শুনতেন। খবর দেখতেন মন দিয়ে।
কোনো অজ্ঞাত মৃতব্যক্তির কথা বললে টিভির কাছে গিয়ে মুখটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার
চেষ্টা করতেন, খবরের কাগজে অজ্ঞাত মৃত ব্যক্তির ছবি বেরোলে
আতস কাঁচে মুখটা বড় করে দেখতেন। টিভির পাশে এখনও ওনার বাইফোকাল চশমাটা আর আতস
কাঁচটা রাখা। আজকের পেপারটাও খোলা, বালিশের নীচে চাপা দেওয়া
খানিকটা। পাখাটা ফুল স্পিডে ঘুরছে। পুরো ঘরটা যেন মৃত্যুর সাথে একটা বোঝাপড়া করে
নিয়েছে, ওরাই শেষ সাক্ষী মৃত্যুর, বহুকালের
সাক্ষী অপেক্ষার।
বৃষ্টিটা আবার কমেছে। লোকে আবার জানলার
সামনে ভিড় করছে। সন্ধ্যে হয়ে রাস্তার আলোগুলো জ্বলে গেছে ইতিমধ্যে। একটা
আলুকাবলিওয়ালা আর একটা ফুচকাওয়ালা ভিড়ের মধ্যে মিশে দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধার চেয়ে বেশি
কৌতুহল মায়ের সাথে আসা বাচ্চাদের দিকে। ইশারায় ডাকছে। অনেকেই খাচ্ছে, এক নাগাড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অনেকেরই
খিদেও পেয়েছে, পা-টায় ঝিঁঝিঁও ধরে যাচ্ছে। কেউ কেউ গিয়ে রকে
বসে পা-টা ছাড়িয়ে নিচ্ছে। নানা কথা উঠছে। "পুলিশ আসতে দেরি আছে তো...",
কেউ বলছে, "বাচ্চাগুলোকে কিছু না খাওয়ালে
রাখা যায় না দিদি"... কেউ বলছে, "এই ভালো হল,
একটা মানুষ কত অপেক্ষা করে, কিন্তু জল পেয়েছেন
বলে তো মনে হয় না...”
হঠাৎ হইহই আওয়াজ উঠল। পুলিশের গাড়ি আসছে।
ওনার শ্বশুর কোনোদিন পুলিশে খবর দিতে দেননি,
ইনিও থানায় যাননি কোনোদিন, এমনকি একবার
ভাড়াটেদের সাথে কাশী গিয়েছিলেন যখন, যে বড় চুরিটা হয়েছিল তার
বাড়িতে, তারপরও পুলিশের কাছে যাননি। কাশী গিয়েছিলেন, কে বলেছিল উনি কাশীতে নাকি, কারা কারা দেখেছে। উনি
ওনার মত দেখতে অনেককে দেখেছেন, ওনাকে পাননি। শ্বশুর চাইতেন
না বাড়িতে পুলিশ আসুক। ইনি চাইতেন পুলিশ আসুক, খোঁজ দিক,
ইনি যাতে একবার জিজ্ঞাসা করতে পারেন তার সামনে দাঁড়িয়ে ---
"তুমি চলে গিয়েছিলে কেন?”
পুলিশ এলো, দরজা ভেঙে ঢুকলো, ওনার চোখের সামনে
দাঁড়ালো, ইনি তাকিয়ে রইলেন, মৃত অপলক
চোখে।
No comments:
Post a Comment