দু-মাসের মধ্যে মানুষের মুখমণ্ডলের এমন পরিবর্তন! রাস্তায় বেরোলে
কাউকে চেনা যায় না। আকারে, হাঁটাচলায়, চেনা জামায় চিনতে হচ্ছে। কেউ মাস্কহীন রাস্তায়
বেরোলে এমনভাবে লোকে তাকাচ্ছে যেন উলঙ্গ হয়ে বেরোলেও এতটা বিস্মিত হত না। যে 'মুখোশধারী
মানুষ' কথাটা নিন্দার ছিল, তাই আজ বাহবা দেওয়ার কথা!
গতকাল একটু বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় বেশ লোকজন।
দেখে ভালোই লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন কই কোত্থাও তো কিচ্ছু হচ্ছে না। এই তো বেশিরভাগ
মানুষই কেমন মাস্ক পরে বাইরে বেরিয়েছে। নিশ্চয় পকেটে, ব্যাগে কোথাও না কোথাও স্যানিটাইজার
থাকবে। আহা এই তো আশ্বাস। এই তো বেশ মনে ফুরফুরে আশা। ওদিকে টিভিতে, ফেসবুকে WHO এর
ওই মোটা চশমা পরা গোলগোল চোখ লোকটাকে দেখলেই মাথাটা গরম হচ্ছে। খালি ভয় দেখায়,
"অ্যাই শুনেছি আপনারা নাকি লকডাউন তুলছেন!! ফল ভালো হবে না কিন্তু!"... ব্যস
দিল ভয় দেখিয়ে। রোজ সন্ধ্যেবেলা উনি আরো দুজন সাগরেদ নিয়ে দশহাত দূরে বসে নিজেরা, তারাশঙ্করের
'আরোগ্য নিকেতন' এর মশায়ের মত নিদান হাঁকবেন, আর আমাদের শুনতে হবে। সেও আবার লাইভ।
কেন রে? সব দেশ জুড়ে এমন ব্যামো হতে চলেছে বুঝতে পারলি না আবার বড় বড় কথা। যেই না আমরা
এখান ওখান থেকে টীকা আবিষ্কারের কথায় একটু আশা পাচ্ছি, অমনি অমন গোলগোল চোখ পাকিয়ে
জীবন মশায় আবার লাইভে চলে এলেন, "আমার তো মনে হয় না এই রোগের কোনো টিকা আবিষ্কার
কোনোদিন সম্ভব হবে"। কেন রে? তোর মা কি জন্মাবার পরে মুখে একটু ঘি চিনি দেয়নি?
বলি এমন তো নয় টিকা নিয়েও মানুষ অমরত্ব পাবে। কোনো না কোনো রোগে তো মরবই রে বাবা, তা
আশাটুকু রাখতে দিবি না? এ কি রকম বেয়াড়া স্বভাব বলোদিকিনি। এত ফ্রাস্টু কিসের জীবনে?
বলি সকালবেলা তোর পাড়ায় মাছটা, সব্জীতরকারি ভ্যানে করে, কি মারসিডিজ করে আসে বলে তো
আর সবার পাড়ায় আসে নারে হতচ্ছাড়া। তোর ওই হাবজিগাবজি বকার জন্য পকেটে টাকা আসে বলে
তো আর সবার আসে না রে পোড়ামুখো। বলি বিজ্ঞানটা না হয় ভালো করে জানিস না বলে এমন বড়
অতিমারী আগেভাগে বুঝিস নি, কেন আমাদের জ্যোতিষবিদ্যাটা তো একটু শিখতে পারতিস। বেণীমাধবের
শিক্ষাটাই না হয় আরো একটু মেজেঘষে আধুনিক যুগের মত করে চালিয়ে নিলেই হত। তবে তো আর
এমন মুখোশধারী, ভাইরাসত্রাসী হয়ে বাঁচতে হত না রে বাবা।
যা হোক, সে আর কত কথা তাকে বলব। আর সে শুনবেই
বা কেন। শুনছি নাকি টিকা আবিস্কার হচ্ছে। কেউ বলছে প্রায় নাকি হয়ে এসেছে। কেউ বলছে
হবে, তবে মেলা দেরি। আর কিছু তো আছেই ভাইরাসদরদী, তাদের তো মনেই হয় না কোনোদিন ওসব
আবিষ্কার হবে টবে।
কথা হচ্ছে লকডাউন তো হয় তো এবার তুলে দিতেই হচ্ছে। কিভাবে রাস্তায়ঘাটে
চলতে হবে সেই সব নিয়ে নানা লেখাও পড়ছি। এদিকে এত গরমেও দুবার নাইতে ভয় পাচ্ছি পাশে
কাশি হয়, জ্বর হয়, নিজেকে খালি খালি পজিটিভ পজিটিভ বোধ হয়। বলা যায় না। কোন জ্বরে কোথায়
নিয়ে গিয়ে ফেলে। তাই খুব মেপে বুঝে চলতে হচ্ছে। যারা ঘরে বসে আপিস সামলাচ্ছে তারা তো
না হয় একরকম বেঁচে গেল। যাদের বাইরে যেতে হবে? মানে এই যেমন আমাদের এই শিয়ালদহ লাইনে
লোকাল ট্রেন চালু হলে? সেখানে সামাজিক দূরত্ব রাখার আশা করা আর তুলসীদাসের ভাষায় কচ্ছপের
পিঠে চুল গজানোর ঘটনা একই, তবে? জানি না। স্কুল খুললে বাচ্চাগুলোর কি হবে? জানি না।
ওদের দূরে বসিয়েও বা কতক্ষণ রাখা যাবে। নিতান্ত মারপিট করতেও তো কাছাকাছি হতে হবে রে
বাবা! স্কুলগুলো তো আর সবরমতী আশ্রম হয়ে যাবে না রাতারাতি! আচ্ছা বাচ্চাগুলোকে সরকার
থেকে সাইকেল খাতাপত্র না দিয়ে একটা করে স্মার্টফোন দিয়ে দিলে হয় না? তাও বা কি বলি।
এতবড় দেশ, এত এত উচ্চমানের ইঞ্জিনিয়ার, এতসব উদ্যোগপতি, একখানা দেশীয় জাতের মোবাইল
বানাতে পারলাম না গো আমরা! যা সব আছে সে তো আর পাতে দেওয়ার মত নয়। সব সেই চীন, কোরিয়া
ওইসব দেশ থেকে আনতে হবে। অথচ আমাদের এত্ত নাকি স্মার্টফোন গ্রাহকের সংখ্যা! যা হোক
সে আর এখন ভেবে কি হবে। যদি দেশীয় মোবাইল বানিয়ে ইন্টারনেটটায় পড়াশোনার জন্য সাইটগুলো
ফ্রি করে দেওয়া যেত, তবে কিছু একটা সুরাহা হত। স্কুল যতটা পারত পড়াত, তারপর তো নানা
পাড়ায় পাড়ায় নানা গৃহশিক্ষক আছে, তারা বাকিটা সামাল দিয়ে দিত। সে তো তারা আগেও দিত,
এখনও না হয় দূরে দূরে বসিয়ে কাজ চালিয়ে যেত। কিন্তু সে কি হবে?
ওদিকে প্রেমিকদের অবস্থাও করুণ। মুখ ঢাকা যে
যায় সেই তার হৃদয়ের প্রেমপীড়ার কারণ কি না সেও ঠাহর করা দায়। চোখের দৃষ্টিতে ভালোবাসা
চেনা যায়, ভালোবাসার পাত্র-পাত্রীকে চিনতে হলে আরো বেশি কিছু লাগে। সেও এক ঝামেলা।
সে ক্ষেত্রেও একটা হাল পেতে হবে। বেরোবার আগে পোশাকের বিবরণ, মাস্কের রঙ ইত্যাদি দেখা
করার জায়গার সাথে সাথে যোগ করে দিতে হবে। আর যারা প্রথম, অর্থাৎ প্রেমান্বেষী তাদের
প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। চোখ আর সুকণ্ঠের ভরসায় এগিয়ে গিয়ে মাস্ক অনাবৃত হলে
সমস্ত সংসার ছলনাময়ী মনে হতে পারে, এমন উদাহরণও বিরল নয়।
অগত্যা সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুব আশাপ্রদ নয়।
যারা খালি বলছেন সব হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, যাবে, তাদের বলি, ঘন্টায় ঘন্টায় হাত
ধুয়ে ধুয়ে এমনিই হাতের যা হাল তাতে কি থাকবে আর কি যাবে বলা খুব কঠিন। বরং 'ঝুলন' কবিতাটা
একবার করে পড়ে দেখুন রবীন্দ্রনাথের, পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা, নিশীথবেলা..দে
দোল দোল......
আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে
মরণখেলা
নিশীথবেলা।
সঘন বরষা, গগন আঁধার,
হেরো বারিধারে কাঁদে চারি ধার,
ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে
ভাসাই ভেলা;
বাহির হয়েছি স্বপ্ন-শয়ন
করিয়া হেলা
রাত্রিবেলা।
মরণখেলা
নিশীথবেলা।
সঘন বরষা, গগন আঁধার,
হেরো বারিধারে কাঁদে চারি ধার,
ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে
ভাসাই ভেলা;
বাহির হয়েছি স্বপ্ন-শয়ন
করিয়া হেলা
রাত্রিবেলা।
ওগো, পবনে গগনে সাগরে আজিকে
কী কল্লোল,
দে দোল্ দোল্।
পশ্চাৎ হতে হা হা ক'রে হাসি
মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি,
যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর
অট্টরোল।
আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে
হট্টগোল।
দে দোল্ দোল্ ।....
(আরো আছে, পড়ে দেখতে পারেন যারা পড়েননি)।
No comments:
Post a Comment