এক কাপ চা খাওয়াবেন?
হ্যাঁ, খাওয়ানো তো যেতেই পারে, কিন্তু
একি আবদার?
রঞ্জন খবরের কাগজ থেকে মুখটা তুলে
পাশে বসা লোকটার দিকে ভালো করে তাকালো। রোগাটে মুখের গড়ন। কালো। সবুজ জামা গায়ে আর
একটা নীল-কালো চেক চেক লুঙ্গি পরে, চোখ দুটো উদাস, তার দিকে তাকিয়ে…
সে আবার বলল, আপনি চেন্নাই মেল ধরবেন
তো? দেরি আছে, আপনি কি এই খড়গপুরেই থাকেন? আমায় একটু চা খাওয়ান না… আমি ভিখারি নই…
আমার টাকার ব্যাগটা পুলিশে কেড়ে নিয়েছে… দেবে না আর... এদিকে আমার এখন একটু চা না হলে
মাথাটা টিসটিস করা শুরু করবে… দিন না প্লিজ…
রঞ্জন উঠল… লোকটাকে চেনা মনে হচ্ছে…খুব
স্পষ্টভাবে মনে পড়ছে না… মনের মধ্যে একটা ঘসা কাঁচ আছে… সেই কাঁচের আড়ালে মাঝে মাঝেই
এর ওর মুখ ভেসে আসে… রঞ্জন এই তিপ্পান্ন বছর বয়সে বুঝেছে মানুষ নিজেকে কোনোদিন স্পষ্ট
বোঝে না… মানুষ আসলেই কোনোদিন বড় হয় না…. ফস করে কখন নিজের অজান্তেই আবার একটা কাঁচা
কাজ করে ফেলে সব ঘেঁটে দেয়….
চা নিল দু'কাপ। লোকটা হাত বাড়িয়ে নিল,
একটু হাসল, বলল বসুন…
কায়দা দেখো, যেন শালা নিজের বসার ঘরে
বসতে বলছে… খড়গপুর স্টেশান না…
রঞ্জন বসল। লোকটা চায়ে একটা সশব্দ
চুমুক দিয়ে বলল, আমার নাম সুজন সামন্ত। আমার বাড়ি এদিকে নয়, কৃষ্ণনগর। এদিকে কেউ চেনে
না আমায়, ক'দিন পর চিনবে।
ক'দিন পর চিনবে মানে?
রঞ্জন খবরের কাগজটা পাশে রেখে, চায়ে
অল্প একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল। লোকটার গলা শুনে মনে হচ্ছে ভদ্রলোক। কথা শুনতে
ইচ্ছা করছে। বলুক, এমনিতেই ট্রেন লেট, আসতে এখনও দেড় ঘন্টা।
সুজন বলল, আমার কৃষ্ণনগরের ভিতরের
দিকে একটা গ্রামে মিষ্টির দোকান। আপনি গেছেন ওদিকে কখনও?
রঞ্জন বলল, না। আমি ওই লাইনে শ্যামনগরের
বেশি আর যাইনি। মাকে নিয়ে কালীবাড়ি গিয়েছিলাম। শ্যামনগর কালীবাড়ি।
হ্যাঁ, বুঝেছি। কি আশ্চর্য না? কালীমন্দির
বললেন না, বললেন কালীবাড়ি…
হ্যাঁ, তাই তো বলে সবাই… মানে আমার
মাসিরা ওখানে থাকতেন… ওদের মুখেই শুনেছি…
না না, ভুল বলেননি তো… ঠিকই বলেছেন।
কালীবাড়িই তো বলে। কথাটা কি দারুণ না? বাড়ি… তা আমারও বাড়ি ছিল জানেন… মানে এখনও আছে…
বিয়ে হয়েছিল তা চার বছর হবে… রাণাঘাটের মেয়ে… পারমিতা… মাধ্যমিক পাশ… আমি উচ্চমাধ্যমিক
ফেল…দেখতে শুনতে ভালো… মানে আমার চাইতে ঢের সুন্দর বুঝলেন… গায়ের রঙ অল্প চাপা হলে
কি হবে… কিন্তু বেশ… আপনি হয় তো ভাবছেন আপনাকে এ সব বলা কেন? আসলে আমার ঘরে থাকতে অসহ্য
লাগছিল… এত চীৎকার করছে না ওরা…
কারা?
সে পরে বলছি…
রঞ্জনের লোকটাকে ভীষণ চেনা লাগছে,
বিশেষ করে পাশ ফিরে যখন কথা বলছে।
লোকটা বলল, এই আপনার হাতের জিনিসটাই
আমার সংসার ভাঙল জানেন…
রঞ্জন নিজের ফোনটার দিকে তাকালো।
লোকটা বলল, হ্যাঁ এইটাই… ওর একটা ফেসবুক
অ্যাকাউন্ট ছিল… সারাদিন ও ওই মোবাইলেই ডুবে থাকত… আমি ভাবতাম বুঝি প্রেমট্রেম করে…
দিন যত যায় নেশা তত বাড়ে ওর… আমার মধ্যে মধ্যে সন্দেহ হয়… কিন্তু সন্দেহ করতে কি খারাপ
লাগে না? যাকে ভালোবাসেন তাকে সন্দেহ করতে কি বুকটা পুড়ে যায় না? অথচ দেখুন যাকে দেখতে
পারি না তাকে সন্দেহ করতে কি ভালো লাগে, যত সন্দেহের কারণ পাওয়া যায় মনে তত আনন্দ…
তাই না? তা আমিও একটা অ্যাকাউন্ট খুললাম। মাসের পর মাস ফাঁদ পেতে বসে থাকি… কই, কিছুই
তো নেই…
রঞ্জন বলল, থাক না, এসব আপনার পারিবারিক
কথা… তা ছাড়া এই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রেমের গল্পটা এত পুরোনো আর একঘেয়ে হয়ে গেছে না,
ভালো লাগে না শুনতে আর…
না ঠিক আমি বলতে চাইছি না জানেন। এটা
তো আপনি বুঝেই গেছেন আমার বউয়ের উপর আমার ক্ষোভ আছে… কিন্তু তা না… আমি আসলে… দাঁড়ান
ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না… আসলে আমি যেটা বলতে চাইছি… আপনি আমায় নার্ভাস করে দেবেন
না, একটু শুনবেন প্লিজ, আমার মাথায় কিছু ভাবনা ঘুরে বেড়াচ্ছে… আমি সেগুলোই ছাড়াতে চাই…
রঞ্জন বলল, বেশ বলুন… চা তো শেষ, আরেক
কাপ আনব?
না না উঠবেন না, আমার ভাবার রেশটা
কেটে যাবে…. বসুন প্লিজ… চাইলে আপনি অন্যদিকে তাকাতে পারেন… ফোন ঘাঁটতেও পারেন… আপনাকে
কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব না আমি… তবু আমার কথায় যদি আপনার মনে হয় কোথাও ভুল… মানে
আপনার অভিজ্ঞতা বলে ভুল, তবে আমায় থামাবেন…
রঞ্জন বলল, বেশ বলুন…
দেখুন, ও আমায় ঠকাচ্ছিল ইনস্টাগ্রামে…কি
করে জানলাম সে গল্পে আর যাচ্ছি না… সে ছেলেটার বাড়ি এখানে… মানে এই খড়গপুরে…
এই দাঁড়ান, আপনি তাকে খুনটুন করে ফেলেছেন
নাকি?
আরে না দাদা… আসলে কথা হচ্ছে আমি ভেবে
পেলাম না, পারমিতা আমায় ঠকালো কেন? আমি তো কোনো অভাব রাখিনি… না আমার মধ্যে কোনো রোগের
বালাই আছে…সবই আমার দিক থেকে তো ঠিকই চলছিল…তবে কি হল বলুন তো?
দেখুন এ সব কেউ বলতে পারে না… এ হয়ে
যায়…
আচ্ছা, আমিই বা কেন জেদ ধরে থাকলাম
বলুন তো… মানে আমি তো জেনেছি বছর খানেক হল, আমি কেন ছেড়ে দিলাম না ওকে… ওকে তো আমি
ভালোবাসি, ভালোবাসা মানে তো খাঁচায় পুরে টিয়াকে লঙ্কা খাওয়ানো না বলুন… এ তো মানুষ…
তাও আমি ছেড়ে দিলাম না কেন বলুন তো? আপনি হয় তো ভাববেন, এ গ্রামের মানুষ, জটিল মনস্তত্ত্ব
বুঝবে না… কিন্তু এ ধারণা আপনাদের ভুল জানেন তো… গ্রামের লোকও ভাবতে জানে… আপনি আমার
ভাবনার ভুলটা ধরিয়ে দেবেন…
রঞ্জন সঙ্কুচিত হয়ে বলল, আরে না না…আমি
ওসব ভাবছি না… বরং আপনার আত্মবিশ্লেষণের ক্ষমতা আমার বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে বলতে পারেন…
হ্যাঁ, কথাটা তাই, আত্মবিশ্লেষণ… আমার
বুকটা পুড়ে যেতে লাগল জানেন… কেন ও আমাকে ঠকাচ্ছে… আমি মুখে কিছু বললাম না, সত্যি বলতে
কোনোদিন বলিনি… গত পরশু যখন ঘর থেকে বেরোচ্ছি তখনও বলিনি… বললাম, কলকাতায় কাজে যাচ্ছি,
ফিরতে দু'দিন লাগবে…
কেন এলেন এখানে?
কারণটা খুঁজতে। ওর সঙ্গে কথা বলে দেখতে
কি আছে ওর মধ্যে। কিন্তু তার চাইতে বেশি আমার যেটা মনে হচ্ছে, আমি কেন আর পাঁচটা মানুষের
মত ব্যবহার করছি। আমি তো বরাবরই মানুষের স্বাধীনতা নিয়ে ভেবেছি। ওর যদি আমাকে ভালো
না লাগে তবে নিশ্চয়ই ও আমাকে সরাসরি বলতে পারত, কেন লুকিয়ে… আচ্ছা ও কি একদিন পালিয়ে
যেত?
দেখুন এ সব কথা কেউ বলতে পারে না…আর
তাছাড়া আপনিই বা এত ভাবছেন কেন? সরাসরি ওনাকে জিজ্ঞাসাই করে দেখুন না...
না, থাক। বরং ও পালিয়ে গেলেই আমি শান্তি
পেতাম। আমি মুখোমুখি হতে চাই না। আমার নিজেকে নিয়ে ভয়। আমি যদি নিজেকে সামলাতে না পারি?
রঞ্জন বলল, দেখুন, আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা
থেকে বলতে পারি, সম্পর্ক একটা খুব জটিল ব্যাপার। আর এই ধরণের সম্পর্ক তো আরো। আমার
প্রায় দুই-তিনেক বন্ধু প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছে, কেউ কেউ পুরো জীবনটা হেরে
বসে আছে… আমারও ব্রেক আপের অভিজ্ঞতা আছে… আমি মুভ অন করে গেছি… বাই দ্য ওয়ে, আমি ব্যাচেলার…আমার
কোনো সম্পর্কে বিশ্বাস নেই… তাই ঠিক এই বিয়েটিয়ে আমার দ্বারা হয়নি…
সম্পর্কে বিশ্বাস নেই মানে?
মানে আমি কোনো কমিটমেন্ট জড়ানো সম্পর্কে
আস্থা রাখতে পারি না আর… ভাসা ভাসা সম্পর্কই ভালো… লেস পেইনফুল…
আপনি নিরাশাবাদী…
জানি না, ভেবে দেখিনি, তবে হতে পারি...
ভালোবাসার মেমরিগুলো ভীষণ সমস্যার কখন হয় জানেন? যখন আপনি ওগুলো আবার জীবন্ত করতে চান…
আই মিন রিপিট করতে চান… আমার মনে হয় ডিজ্যায়ার হল মেমরির আবার জীবন্ত হওয়ার ইচ্ছা…
আমি জানি না আপনি রিলেট করতে পারছেন কিনা… মানে আমার বাংলা ভোকাবুলারি খুব কাঁচা…
আমি বুঝেছি। আপনি বলতে চাইছেন গত স্মৃতিগুলোকে
আবার ফিরে পেতে চাওয়ার ইচ্ছাকে বাসনা বলে, তাই কষ্ট দেয়… আসলে আমার ইংরাজিটা ভালো ছিল…
ওইতেই অনার্স করব ভেবেছিলাম, কিন্তু সায়েন্স নিয়েই যত গোলমাল হল…
হ্যাঁ, আপনি আপনার স্ত্রী'র সঙ্গে
কাটানো স্মৃতিগুলোকে যতক্ষণ না শুধু স্মৃতি হিসাবে দেখছেন ততক্ষণ ওরা আপনাকে কষ্ট দেবে…
ঠিক… জানি না, হতেও পারে… আচ্ছা, আমায়
ডাকছে, আমি আসছি বুঝলেন… হয় তো আবার দেখা হতে পারে…
রঞ্জন জিজ্ঞাসা করতে গেল, “কে ডাকছে”,
কিন্তু তার আগেই সে দৌড়ে চলে গেল। ট্রেন দেরি আছে। রঞ্জন আবার খবরের কাগজটা খুলল। খুলতেই
পিঠের নীচ থেকে উপর একটা ঠাণ্ডা স্রোত বেয়ে গেল।
একটা ছবি। পাশ থেকে তোলা। আনক্লেইমড,
আন-আইডেন্টিফায়েড বডি, খড়গপুর রেলগেটের কাছে পাওয়া গেছে…এতো সুজন সামন্ত!
ট্রেন এলো। এসি টু টায়ার, সাইড আপার
বার্থ।
রঞ্জন শুলো। নীল আলো কামরা জুড়ে। ঘুম
আসছে না। চোখটা বন্ধ করে শুয়ে। হঠাৎ পায়ের কাছে কিছু ঠেকতেই চোখ খুলে তাকালো, সুজন
বসে। আবছা আলোয় বেশ বোঝা যাচ্ছে। পা-দুটো ঝুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, পারমিতার ফোন
নাম্বারটা লিখুন, ওকে জানিয়ে দেবেন প্লিজ, ছেলেটা ভালো নয়… ও এরকম অনেক মেয়ের সর্বনাশ
করেছে…
রঞ্জন বলল, আমায় বিশ্বাস করবে কেন
সে?
সুজন বলল, ওকে বলবেন, ওর ডানদিকের
থাইয়ে একটা লাল তিল আছে... সেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না… অবশ্য রাকেশ জানে কিনা জানি
না…
রঞ্জন বলল, এ কথা আমি বলতে পারব না,
এ অসভ্যতা।
বেশ, তবে ওর পাসওয়ার্ডটা লিখুন, ফেসবুকের…
না না, একি করছেন!…
নীচের থেকে একজন ভদ্রমহিলা বললেন,
কি একা একা কথা বলছেন দাদা… ঘুমাতে দিন না…
রঞ্জন উঠে বসল। সুজনের কাছে মুখটা
নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মরলেন কি করে? আসলে অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছে রঞ্জন, তার মধ্যে
ভয়টা সরে গিয়ে মৃত্যুর উপর একটা তীব্র আকর্ষণ অনুভব হচ্ছে। এদিকে তো সব ছড়ানো, কুয়াশা
কুয়াশা, ওদিকেও কি তাই?
সুজন বলল, মনে হয় হার্ট অ্যাটাক, কি
সেরিব্রাল অ্যাটাক হবে, পোস্টমর্টেম হয়নি এখনও…
ট্রেন চলছে। বসে বসেই রঞ্জন কখন ঘুমিয়ে
পড়েছে…ভোরের আলো ফুটল… সুজন নেই। রঞ্জন দেখল, তার পাশে একটা চিরকুটে একটা পাসওয়ার্ড
আর নাম্বার লেখা। নীচে লেখা, আমি রাতে আসব, আমার খবরটা পেয়ে পারমিতা কাঁদল কিনা জানাবেন।
আমার নিজের জানতে ভয় লাগছে। সেই যখন উচ্চমাধ্যমিক রেজাল্টটা বেরোলো…যাহ স্স্লা…আমার
নামটাই নেই! আমার সেই আতঙ্কটা আবার হচ্ছে…
রঞ্জন টয়েলেটের সামনে এসে দাঁড়ালো।
তীব্র গতিতে ছুটছে চেন্নাই মেল। চিল্কা পেরোচ্ছে। দুটো বগির সংযোগস্থলে এসে দাঁড়ালো।
নীচে লাইনটা চকচক করতে করতে ছুটে যাচ্ছে। দরজা খুলে লাফ দেবে? এই চিল্কায় কে খুঁজে
পাবে? হঠাৎ বুকের ভিতর কান্না উঠল। নিজের অজান্তেই কখন অত শক্ত করে রডটা ধরে ফেলেছে
বোঝেনি। একজন ‘ইডলি বড়া, হাঁকতে হাঁকতে পাশ দিয়ে চলে গেল। কান ফেটে যাচ্ছে ট্রেনের
চাকার শব্দে। জীবন মানে শব্দ। নিজের জন্য চোখের কোল উপচে জল এলো। একটা বাচ্চা সামনে
দাঁড়িয়ে… আঙ্কেল
মেরে হাত পাকড়োগে… মুঝে
উস কোচ মে জানা হ্যায়… নানিকে পাস…
রঞ্জন হাতটা বাড়ালো। তার হাতের মধ্যে প্রবল বিশ্বাসে ধরা নরম খুদে হাত। রঞ্জনের নাকের কাছটায় অভিমানী কান্না এসে জমছে… ভালোবাসার কোনো অন্তিম স্টেশান হয় না… ভালোবাসা মানে নরম ঘাসে ঢাকা মাঠ… কে মরতে যায়… বালাইষাট!
No comments:
Post a Comment