ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে।
নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। উত্তাল। বর্ষার কারণে। এখনও বৃষ্টি পড়ছে।
বাজ পড়ছে। ভয় নেই
মৃত্যুর। ভয় জীবনের। একাকীত্বের। সবার মধ্যে অহেতুকী বাঁচার একাকীত্বের। প্রয়োজন আজীবন
থাকে না জানতাম। তাই বলে নিজের কাছেও নিজের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়? এ সত্যটা বুঝতে পারছিলাম।
মানতে পারছিলাম না। বুঝতে পেরে মানতে না পারার অসহায়তাটা বড় অসহ্যকর। অবশ্য অসহ্যকরই
বা কেন বলছি, সহ্যই তো হয়ে গিয়েছিল।
নিজের কাছে নিজের
কোনো প্রত্যাশা নেই। এটা বৈরাগ্যের মুক্ত আনন্দ নয়। এ হতাশার। বৈরাগ্য, আশাকে অতিক্রম
করে সুখ। হতাশা আশার শূন্যতায়। আমি এমন মানুষ জানি, সে নিজের সব আশাকে অতিক্রম করে
যাবে, নিজের কাছে এমন একটা প্রত্যাশা নিয়ে বাঁচছিল।
দাঁড়াও। সব গুলিয়ে
গেল আমার। তবে কি বৈরাগ্যও নিজের কাছে নিজের এক ধরণের প্রত্যাশা? সব আশা ছাড়িয়ে যাওয়ার
প্রত্যাশা? হবে হয় তো। কিন্তু আমার এখন কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমার আশা শূন্যতার ব্যথা।
হতাশা।
======
আমি ইচ্ছা করেই
এই দুর্যোগের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি। এই নিয়ে চারবার ব্রীজের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম। আমার
ইচ্ছা নিজের মৃত্যুটাকে নিজে চাক্ষুষ করব। আমি দেখতে চাই। আমি নিজের জীবনে অনেকবার
দর্শকের আসন নিয়েছি। আমার বউ আমার মেয়ে আমাকে সম্মান করে না। আমরা দুজনেই আইটিতে কাজ
করি। ভালো রোজগার। শহুরে জীবনের সব ক'টা কৃত্রিম সুখ আমাদের আয়ত্তে। কৃত্রিম কেন বলছি?
বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাঁটি সুখ পাওয়ার ক্ষমতা মানুষ হারিয়ে ফেলে। এতদিকে হাত পা
বাঁধা যে খাঁটি ডুব দেওয়া অসম্ভব। অবশ্য যদি নেশার কথা বলো সে আলাদা।
======
ছোটো শহরে বড় হয়েছি।
বাবা মা অনেক কষ্ট করে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়িয়েছে আমাদের দুইভাইকে। আমার মাথা ভালো ছিল।
তাই এত দূর এসেছি। ভাই ভালো ছিল না পড়াশোনায়, এখন টিউশান পড়িয়ে খায়। আমি বেশ কয়েক বছর
দেশের বাইরেও কাটিয়ে এসেছি। মা বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। আমি রাখতে চাইনি
ঠিক না। আবার চেয়েছিও যে তা-ও না। আমি দেখেছি সব দিক ব্যালেন্স করে চলতে হলে আমাকে
এই সিদ্ধান্তে আসতেই হবে। অনেকে আমার বউকে দায়ী করে। কথাটা পুরোটা সত্যি না। আসলে আমার
মনে হত আমার মধ্যে আমার পরিবারের ওই নিন্ম-মধ্যবিত্তের মানসিকতা থেকে আমি বেরোতে পারছি
না। কোথাও একটা হিপোক্রেসি তো ছিলই। বাবা মায়ের মধ্যেও ছিল। ইন ফ্যাক্ট আছে। পুরো মধ্যবিত্ত
জাতটাই একটা হিপোক্রেসির মধ্যে বাঁচে। কিছু ভ্যালু। সেই ভ্যালু বেসড পরনিন্দা পরচর্চা।
একটা মর্যাল সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স। এসবই আমার ছিল। এখনও আছে। উন্নতি বলতে কিছুটা
নির্লজ্জ হয়েছি। মধ্যবিত্তের ওই হিপোক্রেসির কম্ফোর্টজোনটাকে মাঝে মাঝেই তীব্র আঘাত
করি। ওরা কুঁকড়ে যায়। আমি আরাম পাই। আসলে ওরাও বোঝে আমি পরোক্ষভাবে নিজেকেই আঘাত করছি,
কারণ মূলের দিক থেকে আমি একই দলে। তবে ওরা বোঝে যে, এই বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে
একটা মরবিড টাইপের সুখ পাচ্ছি।
====
হ্যাঁ, আমি মরবিড।
আসলে ভেবেছিলাম ওই ছোটো শহর, ওই পরিবার, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বেরিয়ে এলে নিজের মধ্যে
একটা কসমোপলিটান আমিকে খুঁজে পাব। নিজের কাছে নিজের যে ইমেজ আছে সেটার কাছাকাছি অন্তত
যেতে পারব। আসলে সবটাই একটা ইলিউশান। মানুষ নিজে সে বেসিক মেটিরিয়ালে তৈরি সেই বেসিক
মেটিরিয়ালটা চেঞ্জ হয় না। আমি বিয়ের পর বুঝলাম সেক্স লাইফটাও কম্প্রোমাইজড হয়। হস্তমৈথুনের
সঙ্গে কনজুগাল সেক্সের একটা বড় পার্থক্য হল হস্তমৈথুনের গোটা ব্যাপারটাই ইম্যাজিনেশান
ডমিনেটেড। সেখানে রিয়েলিটি কই? কতটুকু? রিয়েল সেক্স লাইফ অ্যাকচুয়ালি রিয়েল, তাই কম্প্রোমাইজড।
রিয়েলিটি মানেই তো সওদা।
আসলে বেসিকালি আমি
মরবিড। আমার বাবা-মা, আমার বন্ধুবান্ধব, কলিগ, আমার বউ…এখন আমার মেয়ে সবাই আমাকে চিনে
যায়। ইউজ করে। আমি ইউজ হতে দিই। এটা অবশ্যই আমার ভিক্টিম কার্ড। তবু এটাই আমার হিপোক্রেসির
হায়েস্ট লেভেল। এরপরে আমি মরবিড। জাস্ট মরবিড। নাথিং এলস।
=======
আড়াইটে বেজে গেছে।
এতক্ষণে আমার বডি ভেসে কদ্দূর চলে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ আমি একটা শর্টস আর টিশার্ট গায়ে,
মোবাইলটা গাড়িতে রেখে, গাড়িটা শপিংমলে পার্ক করে ব্রীজে এসে দাঁড়িয়ে আছি। শপিংমলে পার্ক
করেছি কারণ রীচা ওখান থেকে গাড়িটা ব্যাকে নিয়ে বার করতে পারে। এখনো ভালো চালায় না গাড়ি।
======
রীচাও ছোটো শহরের।
কিন্তু জন্মগত স্বার্থপর। না, আমি নিন্দা করছি না। ওর গাটস আছে। নিজের স্বার্থপরতা
নিয়ে ওর কোনো কমপ্লেক্সিটি নেই। সে কমপ্লেক্সিটি মধ্যবিত্ত মানসিকতার ঘুণপোকা। ওর নেই।
ও ওর চয়েসের ব্যাপারে ভীষণ অবভিয়াস। কারণ হয় তো ওর মা। ওর বাবা একজন আদর্শ মধ্যবিত্ত
স্বামী, বাবা। দেওরদের হাত থেকে নিজের প্রাপ্যটুকু আদায় করতে রীচার মাকে রীতিমতো কোর্টকাছারি
করতে হয়েছে। রীতার কাছে শুনেছে একবার নাকি সেক্সুয়ালি অ্যাবিউজডও হয়েছে এক কাকার কাছে।
(বাঙালি মধ্যবিত্তের সেক্স ফ্যাণ্টাসি নিয়ে লিখতে গেলে ফ্রয়েডকেও হয় তো দুবার জন্মাতে
হবে।) রীচার মা সবটা হজম করে মেয়েকে বড় করেছে। তাই হয় তো মধ্যবিত্তের রোগটা ওকে ধরেনি।
রীচাই বুঝিয়েছিল
তাকে, সুভদ্র… বেরিয়ে আয়।
=====
আমি, সুভদ্র। খানিকবাদে
লাশ হব। আপনারা বোর হচ্ছেন? তবে এতটা যখন শুনলেন, বাকিটাও শুনুন। আমার হাতের রেখায়
কি আছে আমি জানি না, তবে এটা বুঝেছি যে মানুষ ভীষণ কণ্ডিশন্ড। ফিলোজফিক্যাল শোনাচ্ছে?
এটা হয়। হিপোক্রেসি আর ফিলোজফির একটা প্রাচীন যোগ আছে। আপনাদের মনে হয় না যে মানুষ
যত হিপোক্রিট সে তত ফিলোজফিক্যাল? আমার মনে হয়। আসলে মানুষের যে বেঁচে থাকার ইনস্টিংক্ট,
সেটা কি? একটা স্বার্থপর ইচ্ছা তো? এর মধ্যে সোসাইটি তার মধ্যে কিছু ভ্যালু ইনপুট করে।
শুরু হয় কনফ্লিক্ট। এর থেকে বেরোনোর আদিম উপায় হচ্ছে দর্শন। পাপ আসলে কি? ভ্যালুকে
ফাঁকি দেওয়া আদিম প্রবৃত্তিরাই হল পাপ। এক এক দেশে এক এক ভ্যালু। তাই এক এক দেশে এক
এক পাপ। যে আদিম ইচ্ছাকে কোনো একটা উপায়ে ভ্যালুর ছাড়পত্র পাইয়ে দিয়েছে, সে-ই সমাজে
সুখী। সব চাইতে কমোন উপায়, সামারিটান হয়ে যাওয়া। তোমার ঘরে আগুন লাগিয়েছি। কিন্তু সেটাই
শেষ কথা না। তোমার ঘরে আগুন লাগিয়ে আমি সমাজের বেশ কিছু গণ্যমান্যকে সেই আগুনে হাত
পা সেঁকার সুযোগ করে দিয়েছি। ব্যস! আমার সামাজিক দায় শেষ।
আমি কোনোটাই পারিনি।
ভ্যালুগুলো আমার কাছে ননসেন্স লাগে। আর নিজের ইনস্টিংক্টে চলা আমার সাহসে কুলায় না।
তাই চিরটাকাল আমি অন্যের জুতোয় পা গলিয়ে চলেছি। যাতে ক্ষতিটা হয় হোক, কিন্তু ক্ষতিপূরণের
দায় আমার না থাকে। এটাও ইলিউশন। জানি। কিন্তু এটাই আমি।
=======
আর কথা বলছি না।
ছাতাটা গুটিয়ে নিয়েছি। ব্রীজের এক কোণায় রেখেছি। এখন চারদিক ফাঁকা। এই সুযোগ। এই আমি
উঠলাম রেলিং ধরে। পুলিশের বাঁশি শুনছেন? আমি আগেই খেয়াল করেছিলাম জিপটা আসছে। আমাকে
বাঁচাতে দৌড়াচ্ছে। কেউ চাইছে না দৌড়াতে। কিন্তু ওদের মাথায় কর্তব্যের সামাজিক ভ্যালু।
না চাইলেও দৌড়াবে। নিজেকে কষ্ট দিয়ে এই যে দৌড়াচ্ছে এতে ওদের মনে একটা স্যাক্রিফাইস
করার ফিলিংস হবে। ওতে দুটো লাভ হবে। এক, আরো পাপ করার ছাড়পত্র পাবে, মাফ হয়ে যাওয়ার
আশায়। আর দুই, পাপ না করলেও এক্সট্রা প্রিভিলেজড ফিল করবে নৈতিক প্রতিযোগিতায়। যা ভীষণ
সুক্ষ্ম খেলা। এখানে হার জিতের হিসাব শেয়ার বাজারের থেকেও জটিল। যাক গে, আমি এই ক্রুশিয়াল
মোমেন্টসটাই চেয়েছিলাম….মরতে চাওয়া আর বাঁচতে চাওয়ার মধ্যে একটা বোঝাপড়া। পুলিশের হাতে
সেটা এখন। অবশ্য সবটাই টাইমিং এর উপর। আমার বাঁচা মরাটাও। আপনাদেরও।
No comments:
Post a Comment