আজ অমর্ত্য সেনের জন্মদিন। তিনি নব্বই
হলেন। সেটা বড় কথা নয়। কারণ তিনি শাহরুখ খান নন।
দুজনেই তাদের জায়গায় মহারথী। কিন্তু
জনপ্রিয়তা আবার ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন হয়। এককালে দেখতাম বাংলার তথাকথিত ইন্টেলেকচ্যুয়ালরা
হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের বিষয়ে নীরব থাকতেন। এখন বলেন। এটা ভালো কথা। এখন সেটা
ঘরের আলো কমেছে বলে বাইরের আলো চোখে পড়ছে, নাকি বাইরের আলোর প্রতি আপনিই এক উদারতা
জন্মেছে সে বলা কঠিন এত তাড়াতাড়ি।
বিবেকানন্দ একটা কথা বলতেন, মা যাকে
বড় করে সে-ই বড় হয়, এটা যদি কেউ জীবনে অন্তত কয়েক মুহূর্তের জন্য বোঝে তবেই তার জীবনে
শান্তি আসে। যদিও একদম উদ্ধৃতি দিলাম না, তবে মোদ্দা কথাটা এমন ধারারই ছিল।
এই যেমন ধরা যাক বছর দুয়েক তো লকডাউনে
কাটল। মানে কড়া লকডাউন। অনেক মানুষ প্রায় বিনা পরিশ্রমেই, বা খুব স্বল্প পরিশ্রমেই
অন্তত বেশ কিছুটা সময় গ্রাসাচ্ছদনের চিন্তা ছাড়াই সময় কাটানোর সুযোগ পেলেন। মানে সময়
মত মাসে মাসেই মাইনে ঢুকে গেল ব্যাঙ্কে। উঁহু, না, না, আমি কাউকে কটাক্ষ করছি না, যেটা
ঘটেছিল সেটা বলছি। তা অনেকেই বলেন, বা ভাবেন না, যে পর্যাপ্ত সময় পেলেই একটা বিশাল
কিছু সৃষ্টিশীল কাজ সে করে ফেলতে পারত। কিন্তু কই হল? এই লকডাউনের পর একটা "পুতুলনাচের
ইতিকথা", "নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ", মায় একটা "প্লেগ" কি লেখা
হল? কি সিনেমায়, বা ছবিতে, বা গানে, বা যে কোনো সৃষ্টিশীল কাজের ধারায় এই বিশ্বজোড়া
লকডাউনে, যারা নাকি শুধু "সময়ের অভাবে" কিছু করতে পারছিলাম না, তারা পেরেছি
কিছু? হ্যাঁ, নিজের নিজের শখ পূরণ হয়েছে মেলা। কিন্তু ক্ল্যাসিক বলতে যা বোঝায়, তার
কি কিছু হল?
হল না। অর্থাৎ এই লকডাউন আমাদের গোটা
মানবজাতিকে দেখিয়ে দিয়ে গেল যে সময়াভাবটা আসলেই অজুহাত। সে আর যাই হোক সে মূল ভিলেন
তা নয়।
"উপযুক্ত সময় সুযোগ পেলে আমিও
দেখিয়ে দিতাম" - একটা মহা ভ্রম আসলে। বাংলা থেকে শুরু করে গোটা বিশ্বের সৃষ্টিশীল
মানুষদের অনেকেরই জীবনী সে সাক্ষ্য দেবে যে কথাটা সময় সুযোগের নয় শুধু।
রামকৃষ্ণদেবের একটা গল্প আছে। গ্রাম্য
ভাষায় বলা গল্প। ছেলে শুতে যাওয়ার আগে মাকে বলছে, মা আমার হাগা পেলে আমায় তুলে দিও।
তখন মা বলছেন, বাবা হাগা পেলে আমায় তোমাকে তুলতে হবে না, তোমার হাগাই তোমায় ঠেলে তুলবে।
এই হল কথা। তবে এই নিয়ে আমার একটা
মজার গল্প মনে পড়ল। আমার এক আত্মীয়ের কথা। তিনি বিয়ের পর স্বামীর কর্মক্ষেত্রে সংসার
করার জন্য পৌঁছালেন। তো কর্তা তো তাকে কোয়াটার্সে পৌঁছে দিয়েই কাজে চলে গেলেন। নব বিবাহিতা
বধূটি দেখেন, শৌচাগারে কোনো দরজা নেই। একটা বস্তা টাঙানো আছে। সে বস্তাটা যতক্ষণ প্রাকৃতিক
কাজটা চলবে, এক হাতে ধরে থাকতে হবে।
তো নববিবাহিতা বধূর যথেষ্ট অভিমান,
রাগ, ক্ষোভ হল। সে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন দুপুরে কর্তাটি
আসবেন আর তিনি একহাত নেবেন।
কর্তা এলেন। সব শুনলেন। তারপর তিনি
প্রসন্ন হেসে বললেন, ওগো, তোমার সত্যিকারের বড় বাইরেটা পায়নি, পেলে ও সব বস্তা-টস্তা
মাথায় থাকে? লোকে বনে-জঙ্গলে চলে যায়……
আসলে এটাই হল কথা। নিজের ক্ষোভ আর
জগতের ক্ষোভ - বাস্তবটা না মেনে যাই কোথায়?
এই যে প্রতিদিন গাজা গাজা গাজা শুনে
যাচ্ছি। এত এত নীতি, চুক্তি, প্রতিষ্ঠান, রথী-মহারথী…. কি হচ্ছে? কিস্যু হচ্ছে না।
এই হয়। সে মহাভারতই বলুন আর ইজরায়েল, রাশিয়া। শান্তিচুক্তি কেউ শুনতে চায় না স্বার্থে
ঘা লাগলে। সে শান্তি চুক্তি স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণই যে না নিয়ে যাক। যুদ্ধ হবেই। তাই ইউএন
যখন প্রতিষ্ঠা হচ্ছিল হয় তো আমাদের ব্যাসদেব অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। আমাদের বলেছিলেন,
মূঢ় বালক!
মর্মান্তিকভাবে মারা যাচ্ছে সব। আমরা
সবাই জানি কি করলে কি হত। কে থামলে, কে অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করলে, কে উস্কানি বন্ধ করলে
সব থামে… সব জানি। আমাদের চিন্তায় সে সবই সত্য। কিন্তু বাস্তবে নয়। বাস্তবটা সব কিছুর
বাইরে। আমাদের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ সত্যি বলতে তার উপর? কিস্যু নেই। নোম চোমস্কি জীবনের
অর্ধেকটা সময় ইজরায়েল আর প্যালেস্টাইন নিয়ে কথা বলে কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু হল কি? লবডঙ্কা।
এগুলো কি হতাশার কথা? না। এগুলো হতাশার
কথাও না, আশার কথাও না। বাস্তব কথা। মানুষের ক্ষমতা ভীষণ ভীষণ সীমিত। মানুষের বোধ-বুদ্ধি
অত্যন্ত সীমাবদ্ধ শুধু না, অত্যন্ত ত্রুটি ও চ্যুতিময়। কিন্তু মানুষের ভ্রম আর অজ্ঞানতা
অসীম।
আবার শেষে বিবেকানন্দকে স্মরণ করি।
উনি লিখছেন একটা চিঠিতে, গোটা জীবনটা আর কি, ধারাবাহিক মোহভঙ্গ বই তো কিছু নয়!
যদিও আমি এ কথাটা আবার আমার স্মৃতি
থেকে আমার ভাষায় বললাম। কিন্তু কথাটা এই।
তবে কিসের আশায় ভালো কাজ করব?
বিবেকানন্দ বলছেন, জগতটা কুকুরের লেজের
মত। ও যতই চেষ্টা করো ভালো যতটা বাড়বে, মন্দও ততটাই বাড়বে। এ এক অদ্ভুত সমীকরণ। শুধু
ভালোটা বাড়াবো, এ এক ভ্রম। কোনোদিন হবে না। জগতে ভালো মন্দ সমান সমীকরণে অনন্তকাল ধরে
থেকে যাবে। এটাই বিধান।
তবে আমি বেকার কুকুরের লেজ সোজা করে
মরি কেন?
বিবেকানন্দ বলছেন, কারণ, ওই কুকুরের
লেজ সোজা করতে করতে তোমার আত্মজ্ঞান হবে। তুমি মোহমুক্ত হবে। ধীরে ধীরে।
গীতায় আছে না, কর্মে তোমার অধিকার,
কিন্তু ফলে নেই। কিন্তু তাই বলে কাজ ছেড়ে বসে থাকার অনুমতিও তোমার নেই।
কি ভয়ংকর আয়রনি না? কি ভীষণ ছল! তবু
এই তো সত্য। এর বাইরে যাওয়ার রাস্তা কোথায়?
No comments:
Post a Comment