Thursday, June 19, 2014

পাগলিনী

     আমরা বন্ধুরা পুরী থেকে ফিরছিরাত আটটার ডাউন পুরী হাওড়া এক্সপ্রেসবেশ কিছুটা আগেই স্টেশানে পৌঁছে গেছিট্রেন দেওয়াই ছিল প্ল্যাটফর্মেকামরায় উঠতেই আমরা অবাকআমাদের সিটে বসে একজন বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে, শতচ্ছিন্ন পোশাক, উশকোখুশকো চুলআচরণে বুঝলাম মানসিক ভারসাম্যহীনকি করি, অস্বস্তি লাগতে শুরু করলইতিমধ্যে আমরা প্যাকিং খাবারগুলো উপরের বার্থে সাজিয়ে রাখছিমেয়েটাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হল, বকা হলসে অনড়শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকায় আর, না না বলতে থাকেমহা ফ্যাসাদ! হঠাৎ খাবারগুলোর দিকে তাকালবিস্ফারিত, ক্ষুধার্ত চোখবলল,"বিরিয়ানি?" ওতে রুটি আর মাংস প্যাক করা ছিলবললাম "না, বিরিয়ানি না।" সে কোন কথা শুনবার বা দমবার পাত্রী নাছটফট করতে শুরু করলহিসাবের প্যাকেটকি করিঅগত্যা উপায়ান্তর না দেখে আমরা একটা প্যাকেট ওকে দিয়ে দিলাম। "বিরিয়ানি!" বলে একগাল হেসে খাবারটা বুকে করে নেমে গেলআমি আবার যাতে না উঠে আসে দেখবার জন্য দরজায় গিয়ে দাঁড়ালামদেখলাম উল্টো দিকের একটা অন্ধকার ফাঁকা ট্রেনে উঠতে গেলকি মনে করে আবার ফিরে আমার সামনে দাঁড়ালচোখ ভর্তি জল উপচে গাল বেয়ে পড়ছেহেসে বলল, "অনেকদিন খাইনি বিরিয়ানিগন্ধটা চিনিও নিতে আসবে আমায়বলে গেছে এই স্টেশানে অপেক্ষা করতে..."

     আমি নির্বাক। "কে আসবে নিতে?" জিজ্ঞাসা করলামওর মুখটা সাথে সাথেই কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেলশূন্যদৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলমনে করার চেষ্টা করল কয়েকবারতারপর দু'তিন বার বলল, "আসবে আসবে।" বলতে বলতে মুখের মধ্যে জমল একজন্ম কান্নাছুটে সামনের অন্ধকার কামরায় মিলিয়ে গেল


     আমাদের ট্রেন ছাড়লজানি না কিসে ওকে পাগল করেছে- অপেক্ষা না বিশ্বাসঘাতকতাসে নিজেকে ভুলেছে, তার ভালবাসার মানুষটার পরিচয় ভুলেছে, ভুলতে পারেনি অপেক্ষাটাবার বার ওর হাসিটা মনে ভাসছিলদু'চোখের জলের ধারার মাঝে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তা বোধহয় ও স্বাভাবিক নয় বলেই 

     সারা কামরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্নকামরার ভিতরে জানলা দিয়ে ছিটকে আসা চকিত আলো, ট্রেনের রাতের বুক চেরা ধাতব ছন্দময় গতি আমার ঘুমহারা মনকে উদ্বেল করে তুললকত জীবন এভাবে কক্ষচ্যুত হয়ে ছিটকে যাচ্ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছেসব কি হারিয়ে যায়? জানি না, তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, না হারায় নাএত বড় সংসার শুধুই ফাঁকিকে পাথেয় করে চলতে পারে নাসেই বিশ্বাসেই কালকের সকালের অপেক্ষাট্রেনের হুইসেলও যেন তাই ঘোষণা করল রাতের বুক চিরে- চরৈবেতি চরৈবেতি..






     মনটা শান্ত হল

1 comment:

  1. জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনার সন্মুখীন হতে হয়, যাতে নিজের কাছেই এক প্রশ্ন আসে যে, সত্যিই কি সেই ঘটনাটা সেই মানুষটার জীবনে ঘটার আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল? এত বড় পাপ নিয়ে বিশ্বাসঘাতক বেঁচে থাকে কি করে? আর সরল সেই মানুষটা পাগলের মত ঘুরে বেড়ায় কেন? এই ঘটনা আমাদের ভারাক্রান্ত করে, লজ্জা দেয়...
    সেই সমাজ তাকে কত সহজেই রাস্তায় নামিয়ে দেয়, যে একদিন শখের বিরিয়ানি খাওয়াতে শিখিয়েছিল। তার দোষ এই যে, সে কিছুটা পুড়ে গেছে।

    - সুমন ও তন্ময়

    ReplyDelete