অহংকার কার না আছে। যে
মানুষটা জানে তার অহংকার নেই তার সেই স্বঘোষিত নিরহংকারের দাবী যে কি মারাত্মক তা তার
আশেপাশের মানুষই টের পান।
অহংকার সুক্ষ্ম-স্থূল অনেক প্রকারই হতে পারে,
সেটা নিয়ে আলোচনা না। আজ বলতে ইচ্ছা করছে ছদ্ম অহংকারের কথা। তার কতকগুলো রুপ আছে।
কয়েকটা নেড়ে ঘেঁটে দেখা যাক।
প্রথম - বিনয়:
না না, সত্যকারের বিনয়
না। সে তো অনেক ভাগ্য করলে মানুষের চিত্তে উদয় হয়। আমি বলছি কপট বিনয়ের কথা।
"হে হে, আমি আবার কেন?"..."আহা আমি হলাম গিয়ে সাধারণ মানুষ"......"আরে
আমার জন্য এত ব্যস্ততা কেন!"....ইত্যাদি। এদের মধ্যে "আমি অতি সাধারণ মানুষ"
উক্তিটি সবচেয়ে ভয়ংকর। যে মানুষ নিজেকে সাধারণ বলে ঘোষণা করে প্রতি মুহুর্তে, নিজেকে
সে যে কি অসাধারণ আসনে বসিয়ে রেখেছে সে সেই জানে।
দু'টো কারণে এ ঘোষণা আসে। এক, নিজেকে বিধিসম্মতভাবে
বিনয়ী দেখাবার জন্য। কারণ ইতিহাস সাক্ষী, জ্ঞানী-গুণী মানুষজন চিরকালই নম্র। কিন্তু
সে বোঝে না যে সে নম্রতা তাঁদের উপলব্ধ জ্ঞানই তাঁদের দিয়েছে। অভ্যাসে রপ্ত করতে হয়
নি। ইংরাজীতে কার একটা উক্তি শুনেছিলাম, "তুমি অতটা নম্রতা দেখিও না, কারণ তুমি
ততটা মহৎ নও।"
আরেকটা কারণ - ঢাল হিসাবে।
"আমি সাধারণ মানুষ" - এই হল ঢাল। সব পাপ, সব অন্যায় সমস্তটাই ওই 'সাধারণ
মানুষের' তকমায় ঢেকে ফেলতে চায়। এপক্ষের ধারণা আমি সাধারণ মানুষ যখন, তখন সব কিছু দুর্বলতাকে
প্রশ্রয় দেওয়ার অধিকার আমার আছে। আর সব যা কিছু শুভ, মঙ্গলদায়ক তার জন্য সর্বজনখ্যাত
মহান ব্যক্তিরা তো রইলেনই। এর তীর্যক ফলস্বরূপ যা কিছু ভাল বা মার্জিত তার উপরই এর
তীব্র আক্রোশ আর তার সাথে সন্দেহও - "সত্যিই কি? না ভন্ডামী!"
দ্বিতীয় - নীতি নিপুণতা:
এ আরেক মুখোশ। সত্যিকারের
নীতিনিপুণ না। তার জন্য যথেষ্ট ত্যাগ আর ভালবাসা প্রয়োজন। সে নীতি 'সেফটি-পিন'এর মত
এর তার গায়ে ফোটাবার কাজে লাগে না। সে নিজেই নিজেতে সম্পূর্ণ। "ন ব্রুয়াৎ সত্যম
অপ্রিয়ম"- অপ্রিয় সত্য বোলো না।
এ তা না। এ হল স্বার্থে ঘা লাগার নীতি- নিপুণতা।
"আমি বাবা সব সময় সত্যি কথা বলতেই ভালবাসি".... "আমি আবার অন্যায় সহ্য
করতে পারি না"...."আমার কাছ স্পষ্ট কথা".....ইত্যাদি।
প্রথমদিকে মনে হবে সত্যিই কি ন্যায়বোধ। মিথ্যাটা
বা তিলমাত্র অন্যায়টা সহ্য হয় না। ও বাবা, আরেকটু কাছ থেকে দেখো। হয়তো দেখলে নিজের
ছেলে বউ পিটিয়ে আসল তাতে কিছু বললেন না। কিন্তু পেপার দিতে দেরি করছে পেপারওয়ালা, অমনি
বলবেন, "আমি নীতিতে বিশ্বাসী, ৬টার কাগজ সাড়ে ৬টা হবে কেন?" বা "আমার
ফাঁকি সহ্য হয় না" বা "দেখো এটা রাগের কথা না। নীতির কথা" - এরকমভাবে
বাক্য শুরু হল। তারপর নীতিতত্বের আড়ালে অহংতত্ব ফোঁস ফোঁস করছে, কান পাতলেই শোনা যাবে।
এরকম অজস্র উদাহরণ আশে
পাশে তাকালেই দেখা যাবে, নীতিহীনতা আর কপট নীতিপরায়ণতার ডুয়াল মোড নিয়ে কত কান্ড চারিদিকে।
তৃতীয় - উল্টো কেস:
শীর্ষেন্দু মুখার্জীর
'বিপিন বাবুর বিপদ' মনে আছে? সেই বিপিনবাবু শুয়ে শুয়ে নিজের দু:খের কথা ভাবতে বড় ভালবাসতেন।
ভাবতে ভাবতে তাঁর চোখে জল চলে আসত, আর তাঁর মনটা হালকা হয়ে যেত।
এ অদ্ভুত এক অহংকার। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দু:খী,
দুর্ভাগা, বঞ্চিত মানুষ। "যখনই আমি বেরোব তখনই বৃষ্টি হওয়া চাই/ ট্রেনে বাদুড়ঝোলা
ভীড় হওয়া চাই/ অবরোধ হওয়া চাই" ইত্যাদি। "আমার বেলাতেই পরীক্ষার প্রশ্ন কঠিন
আসে", "আমার দিকে ভগবানের মুখ তুলে তাকানোর সময় কোথায়?"
এরকম হাজার অভিযোগ। শ্রীঅরবিন্দ এই ধরণের অহংকারকে
বলতেন, 'তামসিক অহংকার'। তিনি বলতেন, এইক্ষেত্রে এদের সবসময়েই মনে হয় পৃথিবীতে যা কিছু
ঘটছে তাকে কেন্দ্র করেই ঘটছে। সব তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মানুষ-ভাগ্য-ভগবান
সব তার বিরুদ্ধে। এমনকি সে নিজেও যেন নিজের বিরুদ্ধে। খুব জটিল। অনেকটা কপট বিনয়ের
মত। কিন্তু সেখানে অভিযোগটা কম। এখানে অভিযোগটাই বাদী সুর।
এরকম ছদ্ম অহংকারের হাত থেকে রেহাই পাওয়া খুবই
শক্ত, কারণ তেনাদের ভীষণ সুক্ষ্ণগতি। তবে মনের আরো অনেক বিকারের মত এরও একই দুর্বলতা।
এদের যত শক্তি ছদ্মবেশের আড়ালেই। একবার চিনে ফেললে এদের উৎপাতটা অনেক কমে যায় মনোরাজ্যে।
সেই পরমহংসদেবের গল্প-
একজন বাঘের ছাল পরে ভয় দেখাচ্ছিল। যাকে ভয় দেখাচ্ছিল
সে চিনে নিল। বলল, তুমি আমাদের হরে না? অমনি যে ভয় দেখাচ্ছিল সে হাসতে হাসতে চলে গেল।
এই তো। আর কি!
No comments:
Post a Comment