মানুষটা অনুভব করতে ভয় পেত। তাই রাতদিন ভেবে চলত। একটু জাগলেই নিজেকে বলতো, ভাব...
ভাব... ভাব।
ভাবনাটা যেন হাতের মাটি। যেমন খুশী মোড় দেওয়া
যায়। অনুভূতি তো হাওয়া, কখন কোনদিক থেকে এসে পড়ে, উড়িয়ে নিয়ে যায়... ভেঙে দিয়ে যায়..
মানুষটাকে কেউ ভালোবাসতে চাইলে, সে নিজেকে বলতো,
ভালোবাসা ব্যাখ্যা করো। ভেবে ভেবে খোঁজো। ভালোবাসার উৎস কি? পরিণাম কি? শুদ্ধ ভালোবাসা
কাকে বলে? কামুক ভালোবাসা কি? ভালোবাসায় বয়সের সীমারেখা বাঁধা আছে কি নেই? থাকলে কেন
আছে, না থাকলে কেন নেই... ইত্যাদি ইত্যাদি....
মানুষটার কাউকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করলে, নিজেকে
বলতো, ধুস!
একদিন
এই মানুষটার দেখা হল এমন একজনের সঙ্গে যে ছিল পেশায় গণিকা।
সে মানুষটাকে বলল, শোবে?
মানুষটা বলল, হ্যাঁ।
তারপর তারা সারারাত কতরকমভাবে কামের কত রূপ দেখল।
সেটা ছিল শহর থেকে অনেক দূরে একটা নির্জন টিলার উপর। মানুষটা ভোর হওয়া দেখতে দেখতে
পাশে শুয়ে থাকা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমাকে নিয়ে আজ অবধি কতজনের সাথে শুলে?
সে মিলিয়ে যাওয়া শুকতারার দিকে তাকিয়ে বলল, কাল
রাতে আকাশে যত তারা ছিল তার চাইতেও বেশি....
মানু্ষটা বলল, আকাশ কি তবে তুমি? আর ওই তারাগুলো
সব পুরুষ? আমি কি ওই শুকতারা?
মেয়েটা হেসে গড়িয়ে গেল। বলল, বেশ ভাবো তো তুমি?
তা তুমি কেন শুকতারা হতে যাবে? আমার কি যৌবন শেষ হয়ে গেছে?
মানুষটা বলল, তা অবশ্য ঠিক।
মানুষটা টিলা থেকে নেমে এল। নদীতে স্নান করল।
স্নান সেরে উঠে যেই হাঁটতে শুরু করেছে একজন লোক এগিয়ে এসে বলল, তোমায় দেখলাম তুমি ব্রাহ্মণ।
গলায় উপবীত। তুমি আমার একটা কাজ করে দেবে?
মানুষটা বলল, কি?
সে বলল, আমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মন্দিরে
পুজো চলছে। একজন ব্রাহ্মণ কম হচ্ছে। তুমি কি একটু আসবে?
মানুষটা বলল, আমি জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ, কিন্তু
সারারাত আমি বেশ্যাসঙ্গ করেছি। তুমি কি এ শুনেও ডাকবে আমায়?
সে বলল, চলো। তুমি নদীতে স্নান করেছ। এ পুণ্যদাত্রী
নদী। তুমি শুদ্ধ। এসো।
মানুষটা ভরপেট খেল। পুজোর কাজকর্ম সেরে সবাই
চলে গেল। মন্দিরের দরজাটা ভেজিয়ে পুরোহিত বলল, তুমি আছ, তাই শিকল তুললাম না, আমি আবার
সন্ধ্যেবেলা আসব।
মানুষটা একা একা বসে। ঘুম আসছে। মন্দিরের মেঝেতেই
ঘুমিয়ে পড়ল। স্বপ্ন দেখল মন্দিরের থেকে দেবতা বেরিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ালো। তার পুরুষাঙ্গের
দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর এক কোপে দেহ থেকে আলাদা করে দিল সেটা।
মানুষটা ধড়ফড় করে উঠে বসল। অনেক রাত। মন্দিরে
তালা দেওয়া। তার মানে পুরোহিত পুজো করে চলে গেছে তাও তার ঘুম ভাঙেনি!
দূরে টিলাটা দেখা যাচ্ছে। টিলার মাথায় আকাশে
জ্বলজ্বল করছে ধ্রুবতারা। সে ধীরে ধীরে টিলায় উঠল। অপেক্ষা করল। কিন্তু কেন অপেক্ষা
করবে সে? কার অপেক্ষা? এক গণিকার? আকাশের দিকে তাকালো, যে এত পুরুষের সাথে শুয়েছে?
ছ্যা!
নদীর ধারে এসে দাঁড়ালো। মন্দিরের বাইরে কিসের
জটলা? কাছে গেল। কেউ একটা ভারি কিছু দিয়ে তার মাথায় মারল। অন্ধকারের মধ্যে চোখে আরো
অন্ধকার নেমে এলো।
জ্ঞান হল যখন তখন বেলা। তাকে ঘিরে পুলিশ। মন্দিরের
সব গয়না চুরি গেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করল পুলিশ। সে কেবল বলতে লাগল, এক আকাশ তারার
মধ্যে সেও একটা তারা। তবে শুকতারা নয়... কে শুকতারা?
মানুষটার সব ভাবনা শেষ। সে টিলার উপর বসে থাকে।
আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। শুকতারা যখন আকাশে মিলিয়ে যায় সে নদীতে স্নান করে আসে।
এইভাবে কয়েক বছর গেল। লোকে বলে টিলার উপর এক
তারাসিদ্ধ বাবা আছে। তারাই তাকে খাইয়ে পরিয়ে রাখে। তার নামে গান গায়। অমাবস্যায় তার
পাদোদক পান করলে নাকি কঠিন ব্যাধি সেরে যায়, সব মনস্কামনা পূরণ হয়।
একদিন বর্ষার রাতে, বহুবছর পর সেই গণিকা এই পথে
ফিরছে। সে শুনেছে এই গ্রামে এক বড় তারাসিদ্ধ বাবা আছে, তার পাদোদক পানে সব রোগ যায়
সেরে। গণিকার আজ কঠিন ব্যাধি।
গণিকা চিনতে পারল না তাকে। কিন্তু মানুষটা চিনল।
তার বিশাল দাড়িতে ঢাকা মুখে হাসির ছটা খেলে গেল, দুই হাতে তালি দিয়ে বলল, শুকতারা...
শুকতারা.....
গণিকা তাও চিনতে পারল না। গণিকা তার পায়ের কাছে
লুটিয়ে বলল, তুমিই আমার জীবনে শুকতারা বাবা... আমায় শুদ্ধ করে, সুস্থ করো, নীরোগ করো...
তারাবাবা তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে
থাকল। ভোর হয়ে গেল। আকাশে শুকতারা মিলিয়ে যাবে যাবে করছে.... সে আঙুল দিয়ে গণিকার দৃষ্টি
সেইদিকে ফিরিয়ে বলল, শুকতারা....
তখন মন্দিরে মঙ্গলারতি শুরু হয়েছে। গণিকার গণ্ডদেশ
বেয়ে জলের ধারা। সে বলল, আমায় তুমি গ্রহণ করলে বাবা!! আমি ধন্য... আমার এ পাপজীবন ধন্য...
আমি ধন্য... ধন্য... ধন্য....
[ছবি Suman]
No comments:
Post a Comment