বিজয়া দশমী মানে ছোটোবেলায় ছিল বাড়ির
বড়দের ঢিবঢিব করে প্রণাম। তারপর আত্মীয়স্বজন-পাড়াপ্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে ঢিবঢিব প্রণাম।
আর পেট ঠুঁসে মিষ্টি, নিমকি, গজা ইত্যাদি খাওয়া। কারুর কারুর বাড়িতে আবার চানাচুর দিত।
সেই বাড়িগুলোর উপর আকর্ষণ থাকত আরো বেশি।
তারপর দিনকাল বদলালো। ঢিবঢিব প্রণামটা
হাত জোড় করে হল। সোশ্যালিজম থেকে ইণ্ডিভিজুয়ালিজম বাড়ল। গণ্ডী ছোটো হল। লৌকিকতা বাড়ল,
আন্তরিকতা কমল। রক্তে চিনির হিসাব, মিষ্টি ইত্যাদি কিনতে ট্যাঁকের হিসাব আবেগী-হুজুগ
বাঙালিকে রুখে দাঁড়ালো। ক্রমে শুভেচ্ছা বার্তা চিঠি ছেড়ে হোয়াটসঅ্যাপে এলো। নিজকৃত
টাইপ ছেড়ে ফটোশপে পাঠানো শুভেচ্ছা এলো।
সব ভালো হচ্ছে। এই যে কদ্দিন বাড়ির
সামনে খবরের কাগজ কোলে ওঠার জন্য ছটফট করে না। কদ্দিন ধরে বুড়ো মানুষগুলো খবরের কাগজের
নেশায় বিছানায় এদিক ওদিক করে, পুরোনো কাগজের পাতা উল্টায়, অনলাইনে নিউজ পড়তে পারে না।
এ সব ভালোর জন্যেই হচ্ছে। গাছের পাতা বাঁচছে। ছাপাখানা বিশ্রাম পাচ্ছে। আসলে প্রিন্ট
মিডিয়া বুঝে গেছে যে বৈদ্যুতিক মিডিয়ায় এখন তারা দুয়োরাণী। তাই ওসব কমিটমেন্টের কথা
ভুলে-টুলে গোঁত্তা খেয়ে ঘুম লাগানোই ভালো। অন্তত বাজেটের দিকে তাকিয়েও তাতেই লক্ষ্মীলাভ।
কিন্তু কথা হচ্ছে এই সে বিজয়া দশমী,
এতে বাঙালির দ্বিচারিতা আবার স্পষ্ট হয়ে যায়। এদিকে একদল "মা গেল, মা গেল বলে
হাপুস নয়নে কেঁদে ভাসায়।" ওদিকে আরেকদল রাস্তায়ঘাটে নেশায়-অনেশায় ঢাকঢোলের সঙ্গে
নেচে বেড়ায়। কিন্তু বিজয়টা কিসের? রাবণ বধের না অসুর বধের?
এর কোনো স্পষ্ট ধারণা আমাদের নাই।
তবে ভিলেন হিসাবে দশমাথা রাবণ আমাদের সবুজ ঘাড়-কেতে অসুরের চাইতে হেভিওয়েট। তার একটা
স্ট্রং স্ট্র্যাটেজি আছে। মা সীতাকে স্পর্শ করেননি অমতে। ওদিকে আবার অসুর নাকি মা
দুগ্গার রূপের মোহে-টোহে…. যাক গে ওসব অশাস্ত্রীয় কথা। আসলে রাবণ তো ভক্ত মানুষ। তিনি
মহাদেবের একনিষ্ঠ ভক্ত।
এখন বাঙালি দেখো একজন সেরিব্রাল মানুষ,
তার ভাবনার লেভেলই আলাদা। যেই দেখল রামচন্দ্র নাস্তানাবুদ হয়ে মা দুর্গার স্মরণে এসে
অকালবোধন করছেন, ব্যস বাঙালি বুঝে গেল। ও রামচন্দ্রে কাজ হবে না। তিনি যে মিনিস্ট্রিতে
অ্যাপিল করছেন, মায় নিজের চোখ উপড়ে দিচ্ছেন একটা পদ্ম কম পড়াতে, সেইখানেই ঘাঁটি পাততে
হবে। তাই রামের অকালবোধনই হল আমাদের সঠিক কালের বোধন। কিন্তু হঠাৎ কি যে হল! এই তো
সেদিন, ব্যাণ্ডেল নৈহাটি লোকালে উঠেছি, ও বাবা, একদল অবাঙালি চ্যাংড়া ছেলে উঠল। তারা
যাচ্ছে কল্যাণীর ব্রহ্মাণ্ড বিখ্যাত, ট্রেনে যাত্রীদের দিনরাতের নাভিশ্বাস তুলিত প্যাণ্ডেল
ও বহুত স্বর্ণখচিত মাকে দর্শন করতে। কিন্তু হলে কি হবে, যেই না ট্রেন ছাড়ল, অমনি কি
জোরে জোরে চীৎকার করে "জয় শ্রীরাম" বলতে শুরু করল। শুনেছি নাকি সে মণ্ডপেও
অমন ধ্বনি উঠছে। শয়ে শয়ে মানুষ সে ধ্বনি তুলছে। হবেও বা। কার যে কোনটা অকাল, আর কাল
যে কোনটা ঠিক কাল, এ হিসাব জানে মহাকাল। কিন্তু শুধু কি রামনাম! বাপ রে সেকি গালাগাল
গো। মা-বোন এক করে গালাগাল দিচ্ছে। কেউ কেউ ফুর্তির চোটে নানাবিধ অরগ্যাজমের শব্দ বার
করছে। সারা ট্রেনের লোক চুপ। আমি ভাবলাম এই ভালো। কিছু বললেই আবার যদি বোমাবন্দুক বার
করে বসে! কোনো বিশেষ আদর্শে বিশ্বাস করা আর সঙ্গে সেই আদর্শের প্রয়োগে বন্দুক-পিস্তল-বোমার
যোগাযোগ আমাদের মত নিরীহ মানুষদের পক্ষে বড়ই জ্বালাতনের।
উফ কি কথায় কোথায় এসে পড়লাম। সে রামই
হোক, কি দেবী, কথা হচ্ছে কার ভিলেনের উপর বিজয়ে যে এই বিজয়া আমাদের ধারণা স্পষ্ট নয়।
নাই হোক। হোয়াটসঅ্যাপ জানে আর মেসেঞ্জার জানে, মন তুমি আনন্দে থাকো।
যদিও পশ্চিম ভারতে এই নিয়ে কোনো গোল
নেই। তারা ইয়াব্বড় বড় রাবণ বানায়। অগ্নি সংযোগে তীর মারে। রাবণ পুড়ে মরে। এদিকে বিজয়োল্লাস
হয়।
========
কিন্তু আরেকটা উৎসবও হয়। এইদিন কেরল
সেজে ওঠা আরেক আনন্দে। বাড়ি, মন্দির, লাইব্রেরি এমনকি কিছু কিছু চার্চ, ক্লাবেও হয়
বেশ আয়োজন। তাদের আজ হাতে খড়ির উৎসব। বাড়ির বড়দের কোলে, কি গুরুমশায়ের কোলে, কি বিখ্যাত
কোনো মানুষের কোলে
কুঁচেকাঁচারা বসবে, এক থালা ধান, কি
চাল আর বালি আনা হবে। সেখানে তারা লিখবে, "হরি শ্রী", বা, "হরি শ্রী
গণপতয়ে নম"। তারপর একটা সোনার কয়েন দিয়ে সে পুচকের জিভেও লেখা হবে "হরি শ্রী"
ইত্যাদি। তারপর সেই চালের পায়েস হবে। এই উৎসবের নাম তাদের ভাষায় হল "ইজুথিনইরুথু"।
আরো নাম হল, বিদ্যারম্ভম বা অক্ষরভ্যাসম। ইজুথি মানে অক্ষর। আর ইরুথু মানে শুরু। মানে
হল গিয়ে হাতেখড়ি।
এও এক বিজয়। দেখো, রাবণ, কি অসুরের
চাইতে বড় ভিলেন তো নিরক্ষরতার ভিলেন। সাক্ষর হল মানেই তো সে সব চাইতে বড় আয়ুধ বা অস্ত্রটি
পেয়ে গেল অজ্ঞানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার। কেন সেই স্বামী সহজানন্দের কথা মনে নেই?
যিনি দলিতদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য মন্দিরেই পাঠশালা খুলে বসেছিলেন। নন্দানার এজুকেশানাল
ট্রাস্ট খুলেছিলেন ১৯১৬ সালেই, পরাধীন ভারতেই। বিশেষ করে দলিত মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে
কত কাজই করেছিলেন। সেই সহজানন্দ ছিলেন মহাদেবের ভক্ত।
এখন ওদেশেও গোলমাল হয়েছে খানিক। গোঁড়া
হিন্দু বলেছে এই উৎসব শুধু আমাদের। বাকিরা বলেছে, কেন, এতে সবার অধিকার। অজ্ঞানের বিরুদ্ধে
লড়াই করতে অক্ষরই মহা অস্ত্র। আয়ুধ। দেখো, এই বিজয়াদশমী, কি দসেরা আবার আয়ুধ উৎসবও
তো। তবে? কেন সবাই এতে অংশ গ্রহণ করবে না? হল কোর্টে কেস। গোঁড়ারা হেরে গেল। হাইকোর্ট
বলল সব্বাই নিজেদের ধর্ম, মাতৃভাষা অনুযায়ী শেখাবে। তাই হল। কুন্নুরে এক ক্লাবে, হিন্দু
লিখল, "হরি শ্রী" মালায়লমে। মুসলমান লিখল, "আল্লা হো আকবর", উর্দুতে।
আর খ্রীষ্টান লিখল, "যীশু স্তুতি", ইংরাজিতে।
আসলে এই হল আসল বিজয়। অক্ষরজ্ঞানের
অস্ত্র তুলে দিতে হবে। আর বলতে হবে, অক্ষর দেবে শিক্ষার আসন, সেখানে বসবে সু-চরিত্র।
নইলে অক্ষরজ্ঞানও চলবে ভ্রান্ত। সেই হবে সত্যকারের বিজয়াদশমী। এক্কেবারে সেকুলার বিজয়াদশমী।
No comments:
Post a Comment