আভা জানলার দিকে তাকিয়ে শুয়ে। টিনের
চালা দেওয়া ছোট্টো একটা ঘর। খানিক দূরেই হংসেশ্বরী মন্দির। তার পাশে ওটা নাকি জমিদার
বাড়ি ছিল। রাজার বাড়ি। কি বিরাট বাড়ি! এখন তো এদিক ওদিক ভাঙা ইঁটের দেওয়াল, দরজা। আভা
ওদিকে একটা ভাঙা দেওয়ালে ঘুঁটে দিতে যেত। শীতের দিন দুপুরে একটা চাদর পেতে শুয়ে থাকত
মাঠে। শীতে খুব ভিড় হয় মন্দিরে। আভা শুয়ে শুয়ে দেখত। বসতে পারে না বেশিক্ষণ। ডাক্তার
বলে ঝুঁকে ঝুঁকে বাসন মেজে মেজে ওরকম হয়ে গেছে পিঠটা। এখন তো সোজা দাঁড়াতেও পারে না।
কাউকে ধরে ধরে হাঁটতে হয়।
=======
আভা জানলার দিকে তাকিয়ে শুয়ে। টিনের
চালা দেওয়া একটাই ঘর, এখন মেয়ে থাকে এখানে। বরটা মদ খেয়ে খেয়ে মরেছে। আভা এই বাঁশবেড়িয়া
স্টেশানের কাছেই একটা হোটেলে কাজ করত। মেয়েটা নার্সিংহোমে সুইপারের কাজ করে। দাঁড়িয়ে
কাজ। ওর হাঁটু দুটো যাবে। অবন্তী যখন উবু হয়ে বসে রুটি বানায়, আভা শুয়ে শুয়ে অবন্তীর
হাঁটুর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, মেয়ে হাঁটুটার যত্ন নিস। নইলে কে হাঁটাবে। তোর তো ছেলেমেয়ে
কেউ নেই। খাবারটাই বা কে দিয়ে যাবে?
=======
আভা জানলার দিকে তাকিয়ে শুয়ে। টিনের
ঘরের সামনে রাস্তা। গলি। সেখান থেকে বড় রাস্তা। সেখানে আলো জ্বলছে। পুজোর আলো। আজ অষ্টমী।
আভা দেখল জানলার বাইরে দুর্গা দাঁড়িয়ে আছে। বলছে, দরজাটা এত ছোটো বানালি আভা! ঢুকতে
পারছি না। দশটা হাত তো, আটকে যাবে। আভা দেখে গণেশের ইঁদুরটা, ভোলেবাবার সাপটা সরু দরজা
দিয়ে ঘরে চলে আসে। আভাকে দেখে। অবন্তী তাড়ায়। আভা বারণ করে। অবন্তী শুনতে পায় না। আসলে
আভার কোনো কথাই কেউ শুনতে পায় না। জিভ দিয়ে কথা বলতে পারে না তো। সব কথা মন দিয়ে বলে।
মনের কথা ভগবান ছাড়া কেউ শুনতে পায় না। আভা ভগবানের কথা চিন্তা করে, তার বর সন্তোষের
কথা চিন্তা করে। মা-বাবার কথা মনে পড়ে। তাদের বিহারের বাড়ির কথা মনে পড়ে। জিতিয়া, ছটপুজোর
কথা মনে পড়ে। কিন্তু কি একটা যেন মনে পড়ে না।
=======
আভা জানলার দিকে তাকিয়ে শুয়ে। টিনের
চালার উপর শিশির বিন্দু পড়ছে। আভা শুনতে পাচ্ছে। অবন্তী আজ তাড়াতাড়ি এসেছে। তাকে নিয়ে
যাবে মা দুর্গাকে দেখাতে। মা দুর্গা জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে বলছে, এক কাপ গরম চা খাস।
হংসেশ্বরী মন্দিরের উল্টোদিকের দোকানের। আগে খেতিস তো। এখন এক কাপ বড় চা দশ টাকা নেয়।
খাস।
অবন্তী কোমরের নীচে একটা হাত দিয়ে,
তারপর ঘাড়ের নীচে একটা হাত দিয়ে ধীরে ধীরে তুলল আভাকে। গায়ের থেকে লাল নাইটিটা খুলে
পাশে রেখে আলমারিটা খুলল। আভা উলঙ্গ হয়ে বসে। দেবী দুর্গা জানলা থেকে তাকিয়ে বলছেন,
কি চেহারা হয়েছে রে!
আভা নিজের বুকটা দেখল। পেটটা দেখল।
থাইটা দেখল। চামড়াটা টেনে দেখল। দেবী দুর্গা বললেন, এত সরু গলিতে বাড়ি বানিয়েছিস আভা
আমি ঢুকতেই পারি না। সব বাড়ির টিনগুলো রাস্তার দিকে এগিয়ে। আমার গা, হাতগুলো কেটে যায়।
কাটা হাতে আশীর্বাদ দেওয়া যায় না আভা। আর আমি আশীর্বাদ না দিতে পারলে কেউ আসবে না আমার
কাছে। তোর মত একটা ঘরে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে হবে কবে খাট আসবে, মালা আসবে, লোকজন
আসবে, দুর্গন্ধ বেরোনোর আগে বার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাকে আশীর্বাদ ভুললে চলবে না
আভা।
=======
আভা জানলার দিকে তাকিয়ে বসে। টিনের
চালার নীচে আভাকে উলঙ্গ বসিয়ে কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে অবন্তী। আজকাল সবাই ফিসফিস করে
কথা বলে। আগে বড় রাস্তা দিয়ে লরিগুলো যেত যখন কি আওয়াজ হত! আগে গরমকালে কালবৈশাখী হত
যখন কি মেঘডাকার আওয়াজ হত। আগে ফ্যান ঘোরার শব্দ হত। টিভিতেও কি জোরে জোরে সব কথা বলত।
কেউ রান্না করলে বাসনকোসনের রাখারাখি, ঠেলাঠেলির শব্দ হত। আজকাল সব নিঃশব্দ।
অবন্তী একটা সবুজ নাইটি পরালো আভাকে।
এ নাইটিটা পরে না অবন্তী। এটা রাকেশ দিয়েছিল। রাকেশের সঙ্গে তার পরিচয় এখানে এসেই।
ভালো ছিল না। কিন্তু বোকা ছিল। মিথ্যাগুলো কাঁচা ছিল। রাকেশ মরল এই কল্যাণী ব্রীজে,
বাইকের ধাক্কায়। কষ্ট পায়নি অবন্তী। ওর বোকামিতে সেই প্রথম প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। মদ
খেয়ে নিজেকে সামলাতে ও কোনোদিনই পারত না।
=======
অবন্তী আভাকে ধরে ধরে এনে বাইরে বসালো।
রাস্তার পাশেই একটা উঁচু জায়গার উপর। আভা জানলা দিয়ে দেখল অবন্তী শাড়ি ছাড়ছে। টিনের
চালের উপর একটা ছেঁড়া ঘুড়ি আটকে। আভা আকাশের দিকে তাকালো। লাল নীল আলো ঘুরছে। কোনো
পুজোর হবে। আগে মাইকগুলো কি জোরে জোরে বাজত!
দেবী দুর্গা বলল, হেঁটেই আয়। পুণ্য
হবে। টোটোতে উঠিস না। ওরা ঠকায়। রিকশাও ঠকায়। আমি লরিতে আসি তাই। এত সরু রাস্তায় তো
লরি আসবে না। নইলে আমার লরিটা পাঠিয়ে দিতাম।
=======
অবন্তী এসে আভাকে দাঁড় করালো। অবন্তী
হাঁটছে। আভা অবন্তীকে জড়িয়ে পা দুটো ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হাঁটছে। সবুজ নাইটির গোড়া ধুলোয়
মাখছে। অবন্তী ভাবছে রাকেশের কথা। কত বোকা হলে তার মত কালো মানুষকে লোকে সবুজ রঙের
নাইটি দেয়। অবন্তী একটা লাল শাড়ি পরেছে। নতুন না। আবার খুব পুরোনোও না।
আভা সামনের লম্বা রাস্তাটা দেখছে।
এ রাস্তায় দিনে কয়েক হাজারবার হেঁটেছে। এখন মনে হচ্ছে সামনে পাহাড়। কয়েক পা হেঁটে দাঁড়াচ্ছে
অবন্তী। হাঁফ ধরে যাচ্ছে। কোমরের নীচ থেকে অবশ লাগছে। কিছু কি পাচ্ছে?
পাশে অন্ধকারে অবন্তী বসিয়ে দিল আভাকে।
পিঠটা ধরে থাকল। সবুজ নাইটিটার গায়ে ঘোড়া আঁকা। এতদিন দেখেনি তো অবন্তী! রাকেশ যেন
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। বলছে, মাইঝির হয়ে গেছে…. দেখো অবন্তী….
দেবী দুর্গা দাঁড়িয়ে অন্ধকারে। বলছে,
হবে না এখন রে… সারাদিন কয় ঢোক জল খাস? আভাকে বলল মা দুর্গা। অবন্তী আভাকে তুলে দাঁড়
করালো। আবার হাঁটতে শুরু করল মা মেয়ে।
=======
হংসেশ্বরী মন্দির কি ফাঁকা! মন্দিরের
চূড়াটা দেখল আভা। এক আছে। মন্দিরের গা-টাও একই। মা-কেও দেখা যাচ্ছে। একই রঙ। সবুজ।
না নীল?
দেবী দুর্গার সামনে বসিয়ে দিল আভাকে
অবন্তী। প্যাণ্ডেল ফাঁকা। পুরোহিত পাশে চেয়ারে বসে মোবাইল দেখছে। তার দিকে তাকালো।
দেবী দুর্গা বলল, বসেছিস? কি আশীর্বাদ নিবি?
আভা ভাবল। কিছু ভেবে পেল না। গণেশের
পাশে কলাগাছটা দেখে বলল, কলা হলে দিও। বিচি কলা।
অবন্তী এসে তুলে দাঁড় করালো। দেবী
দুর্গা বলল, চা খেয়ে যাস। দশটাকা।
=======
চায়ের দোকানে ভিড় আছে। অবন্তী আভাকে
একটু দূরে ফাঁকা জায়গায় বসিয়ে চায়ের দোকানের দিকে গেল।
আভা যেখানে বসেছে তার পাশে পুকুর।
দেবী দুর্গা ওপারে দাঁড়িয়ে। জলের মধ্যে ভুড়ভুড়ি কাটছে কি সব। দেবী দুর্গা মাথার চুল
ছেড়ে দাঁড়িয়ে। বলছে, আভা আগে এই পুকুরে স্নান করতিস মনে আছে? আভার মনে পড়ল, তার সব
কথা মনে আছে, কিন্তু নিজের যৌবনবেলার কথা মনে পড়ে না। যেন ছোটোবেলার পরে ঘুমিয়ে পড়েছিল,
ঘুম ভাঙল এই বুড়োবেলায় আবার।
চা নিয়ে এসেছে অবন্তী। দশটাকা বড় ভাঁড়টা।
নিজের জন্যে আর ইচ্ছা করল না। কালকের টোটো ভাড়া হয়ে যাবে। ডান পা'টা টাটাচ্ছে। মায়ের
জন্য চা'টা এনে দিল মায়ের হাতে। আভা দুই হাতে চায়ের ভাঁড়টা ধরল। চোখ খামচিয়ে জল এলো।
তার ঘুমন্ত যৌবনবেলা যেন এই চায়ের গরম ওমে। চায়ের চুমুকে বুকের মধ্যে জ্বালাজ্বালা
ব্যথা করল। নিজের জন্য মন খারাপ লাগল। দেবী দুর্গা নেই কোত্থাও। আভা তাকিয়ে দেখল চারদিকে
শুধু সে-ই দাঁড়িয়ে। কোনোদিন কোথাও কেউ যেন ছিল না। শুধু সে-ই ছিল।
=======
জানলার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আভা। সবুজ
নাইটিটায় ফেরার সময় কখন হিসি হয়ে গেছে। অবন্তী জোরে জোরে হেঁটেছে। দাঁড়ায়নি কোথাও।
রাকেশ বোকা হতে পারে। তবু কাপুরুষ তো নয় যে তাকে ভালোমানুষের অভিনয় করতে হবে! ভালোমানুষ
তো নয়ই। চায়ও না সে ভালোমানুষ। তার বাবাও কি ভালোমানুষ ছিল? সে নিজেও কি ভালো?
আভা জানে কষ্ট পাচ্ছে অবন্তী। সবাইকে
দুষছে। রক্তের জোর কমলে শান্ত হবে। দোষগুণ আর চোখে পড়বে না। চোখে পড়বে শুধু সময়। একটা
ঘেয়ো কুকুরের মত সময় কখনও ঘুমাচ্ছে। কখনও দৌড়াচ্ছে। কখনও পোষ মানছে। কখনও পাগল হচ্ছে।
দেবী দুর্গাকে লরিতে তুলছে। আভা দেখছে।
দেবী দুর্গা লরির চালককে বলছে আস্তে চালাও, সঙ্গে ছেলেমেয়ে আছে।
কেউ কথা শুনছে না। পাগলের মত লরি চালাচ্ছে
চালক। রাকেশের বাইক তছনছ হয়ে গেল। তার বর সাথে আরো চারজন আভাকে নিয়ে লরির মাথায় বসে।
অবন্তীর বর লরির চালকের পাশে বসে মদ খেয়েই যাচ্ছে। দেবী দুর্গা বলছে ওরা কারা নাচছে
পাগলের মত…ওরা কি নেশা করেছে? দেবী দুর্গা দেখছে তার স্বামীও নেশার ঘোরে টলতে টলতে
আসছে লরির সামনে। আভা বলছে, সরে যাও, সরে যাও……
অবন্তী আলো নিভিয়ে ঘরটা বাইরে থেকে
তালা লাগিয়ে চলে গেল। আভা জানলার দিকে তাকিয়ে শুয়ে। টিনের চালার উপর বৃষ্টি পড়ছে মেঘ
ছিঁড়ে। দেবী দুর্গার সব রঙ ধুয়ে যাচ্ছে। সব রঙ গলে গলে পড়ছে টিনের চারপাশ দিয়ে। একটা
ইঁদুর ঘরে ঢুকল। অবন্তী চলে গেলেই ও আসে।
No comments:
Post a Comment