'প্রেম' অনুভূতিটা বিশ্বজনীন, কিন্তু 'ভ্যালেন্টাইনস
ডে'টা আন্তর্জাতিক। এই দুটো শব্দ নিয়ে আজ কথা। যা কিছু বিশ্বজনীন তাই কি আন্তর্জাতিক?
না। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে কোথাও যেন আজকের এই অর্থশক্তি নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে এইদুটো শব্দকে
এক করে ফেলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেন বোঝানো হচ্ছে কোথাও, দেখো যা কিছু আন্তর্জাতিক
আসলে তাই বিশ্বজনীন। আবার এই আন্তর্জাতিক শব্দেরও অনেক জটিল অর্থ আছে। কোন কোন দেশে
তা প্রভাব ফেলেছে দেখতে হবে। যেমন আমাদের দেশের কোনো শিল্প তথা উদ্ভাবিত বস্তু যদি
শুনি কোরিয়া, শ্রীলঙ্কায় স্থান পেয়েছে; তখন আমরা তাকে ততটা আন্তর্জাতিক ভাবতে পারি
না, যতটা আমেরিকাতে পেলে ভাবি। অর্থাৎ মার্কিন মুলুকের লোকেরাই সদর্থে আন্তর্জাতিক
স্বীকৃতি দেওয়ার আধিকারিক। তবে সে অন্য আলোচনা।
আমাদের লেখক কবিকুলের (বিশেষ করে আধুনিক কালের) বিভিন্ন
সাক্ষাৎকারে, তাদের পঠিত প্রিয় কবি লেখকদের যেসব নাম বলেন তাদের বহু মানুষকে উইকিপিডিয়া
খুঁজে আমায় চিনতে হয়। মনে মনে আগে লজ্জা পেতাম, হায় রে এত কম জানি। আজ এই ফেসবুকের
দৌলতে সে রহস্যের সমাধান হয়েছে। অনেককে ব্যক্তিগতভাবে যখন জিজ্ঞাসা করেছি, আপনি কবীর,
দাদু, থিরুভাল্লাভুর, তুলসীদাস, মূল রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি পড়েছেন? তখন দেখেছি রামায়ণ
মহাভারত নিয়ে তাদের জ্ঞান অনেকেরই ওই টিভি সিরিয়াল অথবা ঠাকুমা ঠাকুর্দার মুখে শোনা
গল্পগাথা অবধি। আর বাকিদের মূল লেখা পড়ার অবকাশ পাননি। তাই এখন আর লজ্জা পাই না।
যখন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলো পড়তে যাই,
তখন দেখি তার ব্যবহৃত বেশিরভাগ উল্লেখ, উদ্ধৃতি আমাদের প্রাচীন অথবা মধ্যযুগীয় সাহিত্যকে
আধার করে। বিদেশি নাম নেই যে তা নয়। কিন্তু দেশের গন্ধ অনেক বেশি। অথচ তারপর থেকে আশ্চর্যজনকভাবে
আমাদের মানসলোক থেকে তাঁরা উধাও হয়ে গেলেন। কবে থেকে যেন মনে হল বিদেশি লেখকদের রেফারেন্স
না দিলে যেন আমাদের জাতে ওঠা যাবে না। সে কি রবি ঠাকুরই আমাদের সব্বনাশটা করলেন? আন্তর্জাতিক
হয়ে? কারণ এনারা তো দেখি, তামিল, তেলেগু, মারাঠী কোনো সাহিত্যিকের নামই করেন না। যেন
ওসব দেশে সাহিত্য বলে কিছুর অস্তিত্বই নেই। আর থাকলেও যেন তা নিতান্তই পাতে দেওয়ায়
মত না। এক বিখ্যাত কবি খালি খালি বিদেশী কবিদের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেলফি দিচ্ছিলেন।
তা তাঁকে বললুম, “কত্তা আজ প্রেমচাঁদের জন্মদিন, এমনকি গুগুলও মনে রেখে তার ছবি দিয়েছে,
আপনি যদি দুটো লাইন আপনার টাইমলাইনে ওর সম্বন্ধে লেখেন। তবে বাঙ্গালী আবার না হয় তার
দিকে ক্ষণিক হলেও তাকায়।“ তা মেসেজ পড়া হল। কিন্তু উত্তর এলো না। টাইমলাইনে প্রেমচাঁদও
এলেন না। তার মানে এই নয় যে আমি সঙ্কীর্ণ ন্যাশেনালিজমের পক্ষপাতিত্ব করছি।
আমার বক্তব্য হচ্ছে, বিশ্বজনীন হতে হলে কি আন্তর্জাতিক
হতেই হয়? না তো। কবীর পড়তে গিয়ে, রামচরিতমানস পড়তে গিয়ে, উপনিষদ পড়তে গিয়ে এমন অনেক
লাইন পেয়ে যাওয়া যায় যা বিশ্বমানবের কথা। আর তাই তা বিশ্বজনীন। বহু মানুষ তাদের কথায়
নিজের কথা খুঁজে পেয়েছিলেন। কালের গতিকে তখন হয়তো তারা সে অর্থে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে
পারেননি। তো? খুব কি মান কমে গেল? নাকি বিশেষ কোনো পুরস্কারে ভূষিত না হলে তার মধ্যের
বিশ্বমানবের অস্তিত্ব আমার কাছে অগম্য থেকে যায়?
আমার জানলার সামনে দেখতে পাচ্ছি অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরটা
অন্ধকার হয়ে আসছে এই দিনের বেলাতেও। যদি এই বর্ষা, এই মেঘলা অন্ধকার, এই আমার একা ঘর
আমায় কিছুক্ষণের জন্য মনের পর্দা সরিয়ে গভীর কোনো বিরহকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে, সেই অনুভূতিকে
কি শুধুই বঙ্গীয় বা ভারতীয় বলা ঠিক হবে? বিশ্বের অন্য কোন কোণায় আমারই মত মানসিক গঠন,
এমন কোনো ব্যক্তিরও কি এক অনুভূতি হবে না? নিশ্চই হবে। কারণ এ সর্বজনীন অনুভূতি।
এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম। ইদানীং যখন টলস্টয়ের বিভিন্ন
কালজয়ী লেখায় ডুবে ছিলাম, তখন দেখেছি, যে অনুভূতিগুলোকে উনি ব্যক্ত করে চলেছেন তা সর্বজনীন
অনুভূতি। আর তাই তিনি বিশ্বজনীন লেখক। সেই এক কথা রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, কে সচ্চিদানন্দ,
প্রেমচাঁদ, ত্যাগরাজ, থিরুভাল্লাভুর, জ্ঞানেশ্বর ইত্যাদি সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
আমাদের খোঁজ হোক সর্বজনীন মানবিক উৎকর্ষতার, আন্তর্জাতিক বাজারি চাহিদার নয়। তা না
হলে দিন দিন এক তথ্য-পরিসংখ্যান নির্মিত প্রাচীরে আটকে পড়ে প্রাণের সব রসটুকুকে জলাঞ্জলি
দিয়ে চূড়ান্ত অবসাদের দিকে নিজেকে নিয়ে যাব। আমার ভয় হয় তাই যাচ্ছিও আমরা। বিদেশী সাহিত্য
নিশ্চই পড়ব, তবে তা মানবিক উৎকর্ষতার গুণে পড়ব, আন্তর্জাতিক মহলে নিজের বিচরণ ক্ষমতা
জানানোর জন্যে না। মনে রাখতে হবে, একজন মানুষ শুধুমাত্র নিজের ভাষাটুকু জানলেই তার
মাধ্যমে বিশ্বমনের নাগাল পেতে পারে। অক্সফোর্ড অভিধানের অভাব তার বোধের খামতি ঘটাবে
না, তথ্যের খামতি কিঞ্চিৎ ঘটালেও। উদাহরণ হিসাবে মনে করা যাক আজকের দিনের বিশ্ববরেণ্য
ইরানি পরিচালক আসগার ফরিদিকে। তিনি ইংরাজী ভাষায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। তার
'Separation' সিনেমাটা যখন বিশ্ব দরবারে মনোনীত হল শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র
হিসাবে (সালঃ ২০১১) তখন তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, 'এ সিনেমা তো আমি শুধুমাত্র ইরানের
জন্য বানিয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি তা ইরানের বাইরেও সবাইকে স্পর্শ করবে।' অর্থাৎ তিনি
অজান্তেই বিশ্বমনের কথা বলে ফেলেছেন। তাই হয়, রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্র
তো সাহিত্যের উপলক্ষ্য মাত্র। লেখক বলতে তো চান তাদের মাধ্যমে বিশ্ব মানবতার কথা।'
যেমন নিজের মনকে জানলে বিশ্বমনের গতিবিধি টের পাওয়া যায়, তেমনই নিজের দেশ ও ভাষাকে
জানলেই সর্বজনীন ভাষা ও দেশের গতিপথ অনুসরণ করতে সুবিধা হয়। তাই সবার খোঁজ শুরু হোক
নিজের, তারপর বুঝে যাব স্বতঃই বিশ্বের আত্মীয়তার রহস্য। আন্তর্জাতিক না হলেও ক্ষতি
নেই, বিশ্বমনের অধিকারি না হলে চূড়ান্ত ক্ষতি। তা না হোক এই প্রার্থনা।
No comments:
Post a Comment