গতকাল আমরা একটু বেরোলাম। মাত্র কজন।
কোথায় যাই? ঠিক হল ত্রিবেণীতে বেণীমাধব শিবমন্দিরের ঠিক পিছনে যে দুর্গাপুজোটা হয়,
ওখানে যাই। বাইকেই বেরোনো হল।
বেণীমাধব শিবমন্দিরে এসে দেখি নন্দীর
সাজ চলছে। দুই তিনজন শিল্পী কি যত্ন নিয়ে নন্দীকে সাজাচ্ছে। তার গায়ে তুলি দিয়ে কি
চমৎকার ছবি আঁকছে।
দুর্গামণ্ডপের সামনে গেলাম। দেখি মাকে
রীতিমতো গ্রিলে তালা দিয়ে রাখা। আরাধ্যা সামনে গিয়ে বলল, হ্যাঁ গো, কার্তিক গণেশ কই?
তাই তো। কার্তিক-গণেশ তো নেই? পাশে
একজন বললেন, দুর্গার পাশে যে দু’জনকে লক্ষ্মী-সরস্বতী ভেবে ভুল করছেন, তেনারাও আসলে
জয়া বিজয়া মায়ের দুই সখী।
আরাধ্যা গম্ভীর হয়ে বলল, তবে তো এটা
দুর্গা নয় দেখছি!
আমিও বললাম, তাই তো দেখছি, আচ্ছা ঠকালো
তো আমাদের!
আরাধ্যা বলল, তা নয়, ওই দেখো সিংহ
তো আছে!
যাক। মা এ যাত্রায় সিংহের জন্য মুখরক্ষা
করলেন।
ওদিকে মণ্ডপের পাশে একটা উঁচু জায়গায়
ঢোলটোল নিয়ে বসে সব। চা খাচ্ছেন তেনারা। একজনকে দেখলাম হঠাৎ করে তেলের শিশি বার করে
মাথায় বেশ করে তেল মেখে নিলেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে দুর্গা গারদের ভিতরে
কেন?
একজন হাফপ্যান্ট পরা বয়স্ক কর্তা বললেন,
মায়ের গলায় অনেক গয়না তো… তাই… একটু পরেই খুলে দেওয়া হবে। গয়না নয়, তালা।
বুঝলাম মায়ের গয়নার ভার এনার। তা খানিকবাদে
খুলেও দিলেন। তালা।
আমি আবার এসে বেণীমাধবের সামনে দাঁড়ালাম।
শিল্পীদের কাজ দেখছি। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। একটা বাচ্চা ঠাকুর্দার সঙ্গে এসে আমার পাশে
দাঁড়ালো।
আমি তখন পাশে ঝোলানো বড় করে লেখা ডেঙ্গুর
সতর্কতা পড়ছি। হঠাৎ শুনলাম নাতি জিজ্ঞাসা করছেন, ওটা কি দাদু?
আমি নাতির খুদে আঙুলের ইশারার দিকে
নজর গড়িয়ে দেখলাম বসে থাকা নন্দীর পিছনে একটা গোলাপী অংশকে সে দেখাচ্ছে। সদ্য করা রঙ।
বেশ জ্বলজ্বল করছে। আমিও ভাবলাম, কি ওটা। একটু পরে বুঝলাম ওটি হয় তো নন্দীর অণ্ডকোষ।
শিল্পীর তুলির টানে এমন অপূর্ব রঙে রাঙিয়েছে।
দাদু বললেন, ভালো দেখতে পাচ্ছি না,
চলো দুর্গা দেখে আসি।
======
দুই পা এগোলেই শ্মশান। দোকানিরা মাঝে
মাঝেই রাস্তায় ঝাঁটা হাতে নেমে খই সরাচ্ছেন। সংসারে কিছুই নিত্য নয়। অন্তিমযাত্রায়
যে দুটো খই ফেলে যাচ্ছে সেও হারিয়ে যাচ্ছে পলকেই। যা হোক, কয়েকজন শ্মশানযাত্রী আকণ্ঠ
সোমরসে চুবে বাবার এদিকে আসছেন। আর ঠিক তখনই দুর্গামণ্ডপ থেকে কাড়ানাকাড়া বেজে উঠল।
সঙ্গে সানাইয়ের মত কি একটা, তার আওয়াজ না তো সানাইয়ের মত, না শিঙ্গার মত। ব্যস, বাবার
চেলাদের আর পায় কে? একে সদ্য জাগা শ্মশান বৈরাগ্য, দুই সোমরসের দাপট! তারা দৌড়ে গিয়ে
মণ্ডপে নাচতে শুরু করল। সেকি নাচ! এক্কেবারে কমলায় নেত্য করে থমকিয়া, থমকিয়া! কেউ কেউ
ক্যামেরা বার করলেন। ব্যস, আগুনে ঘি পড়ল। যে নাচ উত্তেজনার শুধু ছিল, সে নাচ এখন হল
তুঘলকি শিল্প। দেখাতে হবে না? কালের কাছে মুখ থাকবে নইলে?
======
ত্রিবেণীর সব চাইতে পুরোনো পুজো নাকি
ভটচায্যি পাড়ার জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন প্রবর্তিত পুজো। গেলাম।
জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের মূর্তি দেখলাম
রাস্তার পাশে। ১৬৯৪ সালে জন্মেছিলেন, ১৮০৭ সালে মারা যান। বিশেষ পণ্ডিত ও শ্রুতিধর
ছিলেন। উইকিপিডিয়ায় বেশ সুখ্যাতি আছে দেখলাম। এখন উইকিপিডিয়া যাকে চেনে সে-ই আন্তর্জাতিক।
যা হোক, তিনিই নাকি এ পুজো প্রবর্তন করেন। সব চাইতে প্রাচীন পুজো। বেশ সুন্দর পরিবেশ।
মায়ের মূর্তিটিও বেশ। বহু বয়স্ক মানুষ আসছেন টোটো, রিকশা, গাড়ি করে দেখলাম। যা প্রাচীন
পুজো, এই বয়স্কদের অনেকেরই ছোটোবেলা, যৌবনবেলার স্মৃতি হয় তো এই প্রাঙ্গণজুড়ে। আবার
এসেছেন, সব একই আছে কিনা দেখতে। নাকি মা একই আছেন কিনা দেখতে।
সামনে বড় মাঠ, সেখানে মঞ্চ বাঁধা।
হয় তো কোনো অনুষ্ঠান হবে বা হয়েছে। বাচ্চারা বাজিতে, ফুচকায়, খেলনায় ব্যস্ত। মহিলারা
কেউ কেউ দেখলাম পাশে ছোটো-ছোটো ঘরে তরকারি কাটছেন। বাইরে অনেকেই সেল্ফি তুলতে ব্যস্ত।
যেমন আজকাল হয় আরকি চারদিকে।
একজন বয়স্ক মহিলা, একাই এতক্ষণ চেয়ারে
বসেছিলেন। হঠাৎ কি মনে হল ফুচকার স্টলের সামনে গিয়ে বললেন, দে তো বাবা দুটো।
অবাধ্য নতুন শাড়িটাকে বাঁ হাতের শাসনে
দুই পা জড়ো করে, তার মধ্যে চেপে ধরে শান্ত করলেন, ধমকে বললেন যেন, চুপ করে থাক।
তারপর জল টলটলে ফুচকাটাকে হাতে ধরে,
সামনের দিকে জাপানীদের মত ঝুঁকে, এমনভাবে মুখে পুরলেন যেন মনে হল প্রথম গুলিটার হাত
থেকে রক্ষা পেলেন। এবার দ্বিতীয় গুলির জন্য প্রস্তুতি। প্রতিবার খেয়াল করছেন শাড়িতে
যেন না পড়ে। তারপর বস্তুটা যখন মুখের মধ্যে চলে যাচ্ছে, দাঁতহীন মাড়িসর্বস্ব পেষণ পদ্ধতিকে
বাগে আনতেও বেশ কসরত করছেন, সঙ্গে তেঁতুলের জল আর ঝালে দুটো বন্ধ চোখ। আমার দেখতে দেখতে
মনে হল ঠাকুমার গালে দুটো চুমু দিয়ে আসি। আট বছরের অভিব্যক্তি আশির গালে ধরা দিলে যেমন
দৃশ্যসুখ হয় আরকি!
তবে একটা ঘটনায় মন চোখ আটকালো। মাঝবয়েসী
একজন মহিলাকে হুইলচেয়ারে নিয়ে দুজন তরুণ তরুণী এলো। বোঝা যাচ্ছে হুইলচেয়ারে যিনি আছেন
তিনি স্বাভাবিক নন মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে। কিন্তু যে দুজন সঙ্গে করে এনেছেন তাকে
তাদের আচরণ কি স্বাভাবিক তার সঙ্গে। কোনো করুণার আতিশয্য নেই, অতিরিক্ত সতর্কতা নেই।
তাকে নিয়ে সেল্ফি তুলছে। তার পিছনে তাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলছে। হুইলচেয়ারে বসা মানুষটার
মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। ভালোবাসার ভাষা কে না বোঝে! কি সহজ যেন সবটাই। তার নতুন লাল জামাটায়
তাকে কি সুন্দর লাগছে। কোনো অভিযোগ নেই, বিষাদ নেই কারোর মুখে। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে
এমন স্বাভাবিকত্ব তাদের, যেন মা'ই বিবশ হচ্ছেন, যেন লজ্জা পাচ্ছেন। এমন ভাগ্যকেও তারা
জয় করে ফেলেছে, কিসের জোরে? শুধুই ভালোবাসা!
=====
এবার ফিরব। এতক্ষণ বাইরে থাকা তো যাবে
না। বাড়িতে আমারও তো অসুস্থ মানুষ রেখে আসা। মাঝে দাঁড়িয়ে চা খেতে হবে একটু।
দাঁড়ালাম। আরাধ্যার বাবা-মা আছে, আমার
আরো কয়েকজন বন্ধু আছে। আমি গেলাম আরাধ্যার জন্য মিষ্টি কিনতে।
মিষ্টির দোকানটা খুব সাধারণ। কয়েকজন
দেবদেবী দেওয়াল জুড়ে আছেন। দোকানি নেই। আমি দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, একজন বয়স্ক
মহিলা এলেন। কি মিষ্টি খাবে? এই ব্যাপারে আমার বুদ্ধি খুব একটা দড় না। আমি আরাধ্যার
মাকে জিজ্ঞাসা করলাম। সে দেখিয়ে চলে গেল। দোকানি রোগা মানুষটা কি যত্নে একটা সাদা কাগজ
ঠোঙার মধ্যে পেতে, তার উপর দুটো মিষ্টি তুলছেন। চোয়াল দুটো বসে গেছে। সিঁদুরের মাথাজুড়ে
থাকা দীর্ঘদিনের অভ্যাসে সাদাচুলে লালের আভা। কিন্তু তবু সব মিলিয়েও অদ্ভুত শ্রী মানুষটার
মুখে। কিছু মানুষ হয় না, মুখের দিকে তাকালেই মনে একটা প্রশান্তি আসে… ইনি তেমন ধরণের
মানুষ। আমি বললাম, আসলে বাচ্চা খাবে তো….
উনি হাইপাওয়ারের মলিন চশমার কাঁচের
ওপার থেকে দুটো স্নেহময়ী চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার মেয়ে?
পাশে একজন এসে দাঁড়ালো… ও মাসিমা গুজিয়া
দাও… কাল পুজোয় দেবে….
ভদ্রমহিলা আমায় ফেরত দেওয়ার জন্যে
টাকা গুনছেন…. সে মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললেন, বৌমাকে দেখলাম না কেন রে…..
সে বলল, বাপের বাড়ি গেছে আজ সকালে…
রাতেই চলে আসবে…..
আমি ভেবে চলেছি আমি কি উত্তর দেব….
ওকি আমার মেয়ে? কি বলব, বন্ধুর মেয়ে?
চারদিকে আমার চেনা তো কেউ নেই। আমি
একা দাঁড়িয়ে। ওরা দূরে চায়ের ওখানে আছে। কি হবে যদি মিথ্যাই বলি?
বললাম, হ্যাঁ আমার মেয়ে।
মিষ্টিটা নিয়ে ফিরছি। পাশেই গঙ্গা।
এতবড় মিথ্যা বললাম? এত লোভ মন তোমার! এত লোভ!
তারপর মনে হল, হ্যাঁ মিথ্যাই যে না
হয় হল। যদি দশভূজা ওই মূর্তি মেয়ে হতে পারে, মা হতে পারে শুধু ভক্তির দাবীতে…. আমার
ভালোবাসায় এতটুকুই কি দাবী নেই…..
তবু মিথ্যাই তো বললাম… মহাসপ্তমীর
মহামিথ্যা…..
No comments:
Post a Comment