এই
সময়টা অনলাইনে কেনাকাটা প্রচণ্ড বেড়ে যায়। ফেস্টিভ সিজন। নানা অফার। দেখেছি এই
সময়ে এমন অনেকে ছেলেকে কাজে নেওয়া হয় যাদের বছরের বাকি সময়ে দেখা যায় না।
আজ
বেলার দিকে একটা ফোন এলো, বলল আমি অমুক কোম্পানি থেকে বলছি, আপনার একটা পার্সেল
আছে, আপনি বাড়ি আছেন? বাড়িটা কোথায়?
আমার
অবাকই লাগল। কারণ আমার বাড়িতে যে ডেলিভারি দিতে আসে সে আমাকে চেনে। ফোন করার কথা
নয়। গতকালও আমাদের পাড়াতে এসেছে, আজ হঠাৎ কি হল? অসুস্থ হল?
যা
হোক, একটা নতুন ছেলে এলো। বয়েস উনিশ কুড়ি হবে। একদম রোগা। একটা ছেঁড়া ছেঁড়া গেঞ্জি
গায়ে। প্যান্টের অবস্থাও তাই। মুখে একটা বড় অমলিন হাসি। যদিও মুখটা রোদে ঘুরে
ঘুরে শুকিয়ে গেছে।
তার
হাত থেকে ডেলিভারি প্যাকেটটা নিয়ে বড় খচখচ করতে লাগল মনটা। এথিক্স বনাম মর্যালিটির
দ্বন্দ্ব। তাকে কিছু দেওয়া এথিকালি অনুচিত, কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে, মর্যালিটির
কাছে ছোটো হয়ে যাচ্ছি তাকে এমনিই ফিরিয়ে দিলে তাকে শুধু হিসাবের টাকাটা দিয়ে।
হিসাবের বাইরেও তো অনেক কিছু থাকে।
তাকে
টাকাটা বাড়িয়ে বললাম, পুজো চলছে, এটা রাখো।
সে
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, কি মিষ্টি হেসে বলল, না দাদা লাগবে না।
আমি
বললাম, রাখোই না।
সে
বলল, না দাদা, অসুবিধা নেই। আমার লাগবে না। তাছাড়া আমাদের নিতে নেই।
সে
চলে যাচ্ছে। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। একটা শতচ্ছিন্ন
গেঞ্জি-প্যান্ট, যেমন গেঞ্জি-প্যাণ্টের অবস্থা হলে কিছুটা অবস্থাপন্ন বাড়িতে
ন্যাতা করা হয়, তেমন পোশাকে কয়েকটা হাড়ের উপর ভর করে আরো কয়েকটা পার্সেল কাঁধে,
বগলে নিয়ে যে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে আমার সামনে দিয়ে, সে আসলে একজন আস্ত মানুষ। যার
হাড়ঘেরা চামড়ার নীচে আছে তার মর্যাদাবোধ। সে কি অনায়াসে বলতে পারে, "লাগবে না
দাদা!"
ভালোবাসা
কাকে বলে আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়, ভালোবাসা এমন কিছু একটা যা মানুষকে
অনাকাঙ্ক্ষিত বোধের হাত থেকে বাঁচায়।
যখন
সে একদম বাইরের গেটটা লাগাতে আবার আমার দিকে ফিরল, যখন দেখল আমি তখনও দাঁড়িয়ে, সে
গেটটা লাগাতে লাগাতে আবার সেই হাসিটা ঠোঁটের কোণায় এনে বলল, শুভ সপ্তমী দাদা।
আমার
চোখ ঝাপসা। বললাম, শুভ সপ্তমী ভাই। ভালো থেকো।
আমাকে
আবার সে মাটিতে বসিয়ে দিয়ে গেল। আবার আমাকে ভাবার শক্তি দিয়ে গেল। আমাকে বুঝিয়ে
গেল কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, যদি ভালোবাসা থাকে। এমনকি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও নয়, যদি কৃতী
সন্তানেরা একবার দিনের শেষে রাস্তার আলো আর উদ্দামতার সমুদ্র পেরিয়ে ভেসে এসে বলে,
আমি আছি। তোমরা একা নও।
তবু
জগতে আজ কি এক ভীষণ দারিদ্র্য। ভালোবাসার দারিদ্র্য। হিসাব ফুরালেই, লেনদেন মিটলেই
সবাই সবার কাছে যেন অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! মানুষের সব
চাইতে বড় সম্পদ তো তার মর্যাদাবোধ! অন্যকে দিলেই তবে সে মেলে। না দিলে যে রিক্ততা,
সে পূরণ করবে কোন অ্যাচিভমেন্ট?
No comments:
Post a Comment