Monday, October 23, 2023

মা

 



'মা' মানে কি? সে কি দেবীর চাইতেও বড়?

দক্ষিণেশ্বর মন্দির। নবমীর সকাল। একজন মহিলা এলেন। সঙ্গে স্বামী। দুই সন্তান। তিনি দারুণ সেজে এসেছেন। খুব সাবধানে চলাফেরা করছেন। নাটমন্দিরে দাঁড়ালেন। হাতজোড় করে। মায়ের দিকে। সেখানে তো পুজোর লাইনে মানুষের পর মানুষ। একটু ফাঁক হলেই মায়ের মনমুগ্ধকর, জগত আলো করা হাসি। গালটা অল্প অল্প কেঁপে উঠল। তারপর নীচের ঠোঁট। তারপর দুই চোখ থেকে জলের ধারা গালের রঙ বেয়ে নামতে শুরু করল। রঙ চটল। কিন্তু কে খেয়াল করছে? ঢাক বাজছে পাশেই। ছন্দ জাগছে। ওই তো ঠাকুরের ঘর। ঢোকার নিয়ম নেই। দরজায় বসে আছেন দ্বারী। চরণামৃত দিচ্ছেন। ফুল দিচ্ছেন। দরজায় দাঁড়ালে দৃষ্টি নত হয়ে ঘরে বসছে। মন বলছে, মায়ের কাছে এলাম। সব শান্ত। মা মানেই সব।

======

বেলুড় মঠে দুর্গামণ্ডপে পর্দা দেওয়া। ভোগ নিবেদন হচ্ছে। সন্ন্যাসীরা গান গাইছেন। মায়ের নাম। মায়ের মহিমা হয় না। মায়ের আশ্রয় হয়। আশ্রয়ের মহিমা হয় না, শীতলতা হয়। সব শান্ত। গানে বিহ্বল। সুরে বিহ্বল। পাশে গঙ্গা। পাশে ঠাকুর। পাশে স্বামীজি। পাশে ব্রহ্মানন্দজী। পাশে শিবানন্দজী। আরো কত মানুষের পায়ের ধুলো। শান্তি। মাধুর্য। আনন্দ। অশ্রু গড়িয়ে গাল বেয়ে নামছে হুইলচেয়ারে বসে বসে। শরীরে চলাফেরা নেই। মন ছুটছে গোটা বেলুড়মঠ জুড়ে। মা মানে অভয়। মা মানে আশ্রয়। মা মানে জানা আর অজানার মাঝে তট। অজানা সাগরের ঢেউ লেগে যাচ্ছে অনবরত, চেনা তটে। মা জানেন সব। অজানাকেও মা জানেন। অনাদির যিনি আদি। সব কারণের যিনি কারণ। আমি যেখান থেকে শুরু যেখানে গিয়ে শেষ সবটুকু জুড়ে মা। মধ্যেখানেও আমার 'আমি'কে ঘিরে মা। মায়ের আশ্বাস। মায়ের বাণী। মায়ের সব চাইতে গভীরতম বাণী কি? আমি মা। এ কেউ বলতে পারে না। শুধু মা পারেন। মায়ের নামই মায়ের বাণী। মা নামই মন্ত্র।

======

ব্যাণ্ডেল স্টেশান। প্ল্যাটফর্মের উপর একটা প্লাস্টিক পেতে ভাত খাচ্ছেন এক প্রৌঢ়া। প্লাস্টিকে তরকারি। প্যাণ্ডেল থেকে দেওয়া। গরম ভাত। ভাতে ফুঁ দিচ্ছেন। তরকারিতে ফুঁ দিচ্ছেন। নিজেকে খাওয়াচ্ছেন। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন। এ তাগিদ মায়ের তাগিদ। নিজেকে নিজের মা হতে হয়। নিজেকে শুশ্রূষা করতে হয়। বুকের ভিতর থেকে আটপৌরে শাড়ি পরে মা বসেন। বলে দেন, এত গরমভাত মুখে দিস না। জিভ পুড়বে। ফুঁ দে। আমিই দিচ্ছি ধরে নে।

বেলুড়মঠে খাওয়ার জায়গা। প্লাস্টিকের থালায় খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে চাটনি। বোঁদে। সবার প্লাস্টিকের থালা নয়। কেউ কেউ এনেছে বাড়ির থালা। মায়ের কাছে খিদের কথা বলতে লজ্জা কি? কেউ এনেছে কৌটো। ভরে খিচুড়ি নিচ্ছে। পাশে রাখা। বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। ততক্ষণে নিজের জন্যেও কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। শয়ে শয়ে মানুষ খাচ্ছে। মা বাতাস করছেন। খিচুড়ি জুড়াচ্ছে। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।

======

ঠাকুর বলছেন, একটু মায়ের নাম শুনব। ভগবান মানে বোঝো না-ই বোঝো। আনন্দ মানে তো বোঝো। আনন্দ মানে মা। মায়ের নাম করো একটু শুনি। গাইতে জানো না? হতে পারে না। মানুষের কান্নারও সুর আছে। যে কান্না যত গভীরের সে কান্না তত প্রাণ নিংড়ানো। আমি নিংড়ানোর সুরের কথা বলছি। মায়ের নাম প্রাণ নিংড়ে গাও। প্রাণ আজ আছে কাল নেই। প্রাণে মায়ের নামের আগুন জ্বালাও। "একা যদি না পারিস মন রামপ্রসাদকে সঙ্গে নে না"। রামপ্রসাদ সুর দেবে। কথা দেবে। তুমি শুধু প্রাণ দেবে। নিংড়ে বার করবে সুর। মায়ের নাম গাও। নোঙর মাটি পাবে। পাল বাতাস পাবে।

No comments:

Post a Comment