যখন স্কুলে পড়ি তখন সুনীলবাবু'র 'কেউ কথা রাখেনি' প্রথম
শুনলাম। মনে হয়েছিল, তাই, এমন হয়?
আমার সাথেও এমন হবে? তারপর যখন বেশ কিছুটা বড়
হলাম, তখন মনে হল, না, সবাই হয়ত এমন হবে না। কেউ কেউ হবে। হল কেউ কেউ, আবার
হলও না।
এখন মনে হয় হলেই বা কি। প্রতিশ্রুতির কোনো প্রতিশ্রুতি হয় নাকি? হয় না। প্রতিশ্রুতি শরতের আকাশের মত।
কখনও কখনও মেঘ কালোও হয়ে আসে। ঝড় হয়। জানি হওয়ার কথা ছিল না। তবু হয়। প্রতিশ্রুতিও
তেমনই।
দু'রকম
প্রতিশ্রুতি হয় – উচ্চারিত, অনুচ্চারিত।
আঘাত লাগে বেশি অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি ভাঙায়। যেন কারোর কাছে স্পষ্ট করে কোনো
নালিশ জানানোর নেই। সবাই বলবে, “কেন সবই তো ঠিকই চলছে। তোমার
এত কিসের নালিশ? এত কিসের অভিমান?”
সত্যিই তো। যে প্রতিশ্রুতির
বাক্যের শরীর নেই, যে প্রতিশ্রুতি শুধুই অনুভবের, তার কি কোনো মূল্য আছে? যেমন আমার বাড়ির পিছনের
বাঁশঝাড়ে একটা দোয়েল পাখি প্রতিদিন বিকালে সূর্যাস্তের আগে আগে এসে বসে থাকত একদম
উঁচু বাঁশটার মাথায়। হাওয়ার দুলুনিতে দুলত, কিন্তু উড়ে যেত
না। ক্রমে অন্ধকার নামত। চারদিক থেকে শাঁখের আওয়াজ বেজে উঠত। আমি আর দোয়েল পাখিটা
আকাশের বিরাট পট পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে নিজেদের মধ্যে একটা যেন আত্মীয়তার সূত্র
তৈরি করে ফেলেছিলাম নিজের অজান্তেই। শুকতারা, দোয়েল আর আমি।
এমন হত কোনো কোনোদিন পাখিটা আসত না। আমার প্রথমে অস্বস্তি হত। তারপর রাগ হত। কেন
আসবে না? বুঝলাম, আমি প্রতিশ্রুতির
জালে জড়িয়ে। অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতির। অভ্যাসের প্রতিশ্রুতির। এ অভিমান অর্থহীন,
কিন্তু অস্তিত্বহীন নয়। কিন্তু মুশকিল হল কাজের জগতে অস্তিত্বের
চাইতে অর্থের মূল্য অনেক বেশি। সে অন্য প্রসঙ্গ যদিও। সংসারে কত কিছুর অস্তিত্ব
নেই, কিন্তু তার মস্ত অর্থ মানুষের কাছে। যেমন বড়লোক হওয়া,
ক্ষমতাশালী হওয়া। কেমন নিজেদের মধ্যে গল্প বানিয়ে মানুষ তাতে বাস
করছে সে হারারি ছাড়া আর কে জানে? কিন্তু তার জন্যে 'সেপিয়েন্স' পড়া লাগবে। এখন সে কথা থাক।
তো কথা হচ্ছিল অনুচ্চারিত
প্রতিশ্রুতি নিয়ে। যে প্রতিশ্রুতির শব্দের শরীর নেই। বাক্যের মানচিত্র নেই।
প্রযোজ্য শর্তাবলী নেই। কিন্তু যা ভাঙলে তীব্র যন্ত্রণা। নিঃশব্দ যন্ত্রণা। জীবন
মানেই এমন কত লক্ষ অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি, না? যাদের আমরা ধরেই নিয়েছি হবে। যেমন আমি একটা নির্দিষ্ট বয়েস অবধি বাঁচবই,
আমার যেগুলো যেগুলো পাওয়া উচিত বলে মনে করি জীবন যেন সে সব আমাদের
একে একে হাতের কাছে, শ্রমের কাছে এনে ধরা দেবে। আমরা সফল হব।
প্রতিষ্ঠিত হব। (যে প্রতিষ্ঠা শব্দটাও তেমনই অস্তিত্বহীন অর্থপূর্ণ মানুষের বানানো
গল্প। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে ওরকম নানা অপ্রতিষ্ঠিত মানুষের অবদানে সমাজ ঋণী;
বিজ্ঞান, দর্শন, খেলা,
সাহিত্য ইত্যাদি সব পথেই এমন উদাহরণ অজস্র।)
হয় না। সব প্রতিশ্রুতি পূরণ
করে না জীবন। “ওগো ভোলা ভালো তবে, কাঁদিয়া
কি হবে”... এ একটা যেমন পথ, তেমন,
“নেই যদি বা জমল পাড়ি, ঘাট আছে তো বসতে পারি /
আমার আশার তরী ডুবল যদি দেখব তোদের তরী বাওয়া” – এও একটা পথ।
যার মূল সূত্র পাওয়া রবীন্দ্রনাথের ‘উদাসীন’ কবিতায়।
কারণটা গভীর। আমার প্রাণের
গভীরে আছে একটা প্রতিশ্রুতির প্রত্যাশা। আমি সংসারে ঢুকেইছি যেন অনেকগুলো কুপোন
হাতে করে। প্রতিটা কুপোনে কি কি আমার পাওনাগণ্ডা আছে জীবনের কাছে সে সবের লিস্টি
দেওয়া আছে। আমি একটা একটা করে কুপোনের গোপন সাংকেতিক অক্ষরমালা আবরণমুক্ত করব আর থলে
ভরে ভরে জীবন দু'হাতে আমায় উজাড় করে সব গুছিয়ে হাতের কাছে
দেবে। না দিলেই ফুঁসব। অভিমান করব। প্রচণ্ড রাগে নিজের ক্ষতি করব। নিজের শরীরের না
পারি, নিজের বিবেক-বিবেচনার গলা টিপে আত্মিক আত্মহত্যা করব।
তারপর আমার সমস্ত অনিয়ন্ত্রিত, অমার্জিত, অশাসিত প্রবৃত্তিরাজি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব সংসারে, যা
পাই, যেটুকু পাই লক্ষ্যে নয়, সবটুকু
চাই, এটাও চাই, ওটাও চাই --- লোভে।
প্রত্যাশা আর প্রতিশ্রুতি
ক্রমে কুয়াশার মত মিলিয়ে যেতে শুরু করে। যা পূরণ হয় না সেও যেমন জ্বালা ধরায়,
যা পূরণ হয়, সেও ক্রমে ফিকে হয়ে আসে। মনে মনে
বলি, পূরণ হোক চেয়েছিলাম, কিন্তু ঠিক
এভাবে নয়। কিন্তু ঠিক কিভাবে যে সেও স্পষ্ট নয়। তারপর একটা সময়ের পর বুঝতে শিখি
আসলে প্রতিশ্রুতি বলে কিছু পাকাপোক্ত হয় না। কারণ কিছুই পাকাপোক্ত হয়ে ওঠেনি
মানুষের সংসারে আজ অবধি। এমনকি তার অচ্যুত ঈশ্বরের ধারণাও হাজারবার রঙ পরিবর্তন
করে এত বেশি অন্য রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে নতুন করে সেখানেও কোনো প্রত্যাশা নেই।
তবে প্রতিশ্রুতি আসক্তির কি
কোনো ঔষধ নাই? আছে। বাস্তব বোধ। যুক্তির চাইতে বড় কথা
যুক্তির বাস্তবতার মান যাচাই করা। যাকে আমরা কাণ্ডজ্ঞান বলে থাকি। আমার জীবনটা যে
একটা কাণ্ড, কোনো কাণ্ডের স্থির ফলাফল নয়, এটা বুঝলেই অনেকটা শান্তি। তাই কাণ্ডের সাথে কাণ্ডের প্রবাহে কোনো
ধ্রুবতারা না রাখাই ভালো। যেটুকু আসে, যেটুকু থাকে, যতক্ষণ থাকে – সেইতেই নিজেকে সন্তুষ্ট করে নিতে না
পারলে শুধু কাণ্ডটাই ঘটে যাবে। আমি স্থিরতার লোভে ভুলেই যাব, আমায় স্থির থাকতে বলা হয়নি, সাম্যে থাকতে বলা
হয়েছিল। চলার মূল কথাটা শুধু এগোনো নয়, নিজের সাম্য বজায়
রাখতে পারাটাই গোড়ার কথা। যেমন পায়ের উপর দাঁড়ানোটা গোড়ার কথা, চলাটা পরের।
তাই বলছিলাম শুরুতেই, এখন মনে হয় প্রতিশ্রুতি ভাঙুক। ক্ষতি নেই, প্রতিশ্রুতিকে
বাইরের দরজার বাইরে না রেখে, আবার শোয়ার ঘরে খাটে না তুলে,
বসার ঘরে বসিয়ে চা-সরবত খাইয়ে সৎকার করাটাই শ্রেয়। তারপর যখন যেতে
চায় গেল।
No comments:
Post a Comment