আমি লোকটাকে চিনি জানলা দিয়ে। টিউবের আলোতে, সন্ধ্যেবেলা,
দশ বাই বারো, পলেস্তারা খসা ঘরের মধ্যে। রোজ
দেখি বলব না। প্রায়ই দেখি। একটা বুড়ি ময়লা সেই ঘরে মশারির মধ্যে অচেতন প্রায় শুয়ে
থাকত, দেখতাম। মাথার উপর বয়স্ক পাখাটা আয়ুর সীমারেখা ছাড়িয়েও
ঘুরছে। লোকটা একটা লুঙ্গি পরে খালি গায়ে চেয়ারে একটা পা তুলে, একটা পা মাটিতে রেখে, হয় মুড়ি চিবাচ্ছে, নয় চা খাচ্ছে, নয় গা চুলকাচ্ছে, নয় টিউবের আলোয় চকচক করা মাথাটায় হাত বোলাচ্ছে দেখতাম। দেওয়ালে একটা কালীর
ছবির ক্যালেন্ডার তারিখ হারিয়ে ডানদিক বাঁদিক দুলছে, আলনায়
অবিন্যস্ত কাপড়জামা, জানলার উপর একটা টুথব্রাশ, পেস্ট, দেওয়ালে একজন বুড়ো মানুষের ময়লা কাঁচ ছবি।
বাবা হবে লোকটার। আর একটা বেড়াল দেখতাম কখনও জানলায়, কখনও
লোকটার কোলে।
দুর্গাপুজোর সময় ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটার উপর সার দেওয়া নীলচে মায়াবী
আলো লাগানো হয়। কয়েকবার দেখেছি বুড়িটা ফ্যালফ্যাল চোখে জানলার দিকে তাকিয়ে শুয়ে।
চোখের মণিতে নীল আলোর বিন্দুগুলো ভিড় করে, অর্থহীন
শূন্যদৃষ্টিকে কিছু বলছে যেন। বুকের থেকে আঁচলটা খসে ময়লা বিছানার চাদরটায়।
শীর্ণস্তনদুটো তবু মাতৃত্বের গর্ব নিয়ে বেঁচে। আমি দেখতে চেষ্টা করতাম লোকটা যে
লুঙ্গিটা পরেছে সেটা নতুন কিনা। নতুন থাকত। যেদিন ওনার মায়ের কাপড়টা নতুন থাকত।
একবার পুজোর সময় আমি দেখেছিলাম ওদের বাড়ি অনেক লোক। বাইরে কুমার শানুর গান
মাইকে, কত যে সাগর নদী... আমার মনটা শান্তি লাগল, যাক, কেউ তো আত্মীয় এসেছে এবারের পুজোয়। লোকটাকে
দেখে ভুল ভাঙল। সাদা ধুতি গায়ে, হাতে মাটির পাত্র, পুকুরটার ধারে খাবার দিতে যাচ্ছে।
এরপর আমি একদিন স্বপ্ন দেখলাম, লোকটার জন্মদিন।
খাটের পাশে টেবিলের উপর রাখা কেক কাটছে একটা একা একা। সম্পূর্ণ একা না। বেড়ালটা
খাটে বসে কেক কাটা দেখছে। মশারিটা একদিকে ভাঁজ করে রাখা। লোকটা কেকের কিছুটা
বেড়ালটাকে দিল। নিজে খেল। তারপর মাকে দিয়ে এল পুকুরপাড়ে। সে চলে যাওয়ার পর তার মা
পুকুরের জল থেকে উঠে এল। বসে বসে কেকটা খেল, আকাশের দিকে
তাকাল, আকাশে তখন ভরতি তারা।
লোকটাকে দেখলে মনে হয় লোকটা কোনোদিন বরফ ঢাকা পাহাড় দেখেনি, সমুদ্র দেখেনি, মরুভূমি দেখেনি, জঙ্গল দেখেনি। সে তার ভাঙা কাঠের দরজার পাশে ফোটা নয়ন তারা দেখেছে,
থালা ভরা ভাত-ডাল-তরকারি-মাছ দেখেছে, বর্ষায়
ভিজে যাওয়া, না শোকানো লুঙ্গি দেখেছে, মায়ের
স্নেহময়ী চোখ দেখেছে, মায়ের ক্লান্ত শীর্ণ, নির্বাক আসবাবের মত শরীর দেখেছে, আয়নায় বারবার বদলে
যাওয়া নিজের মুখ দেখেছে।
আমি আরেকদিন স্বপ্ন দেখলাম, আমি ওর বাড়ি বেড়াতে
গেছি। ও আমায় ঘরে বসালো। আমি জানলার বাইরে দিয়ে দেখা খাটটায় নিজেকে বসে থাকতে দেখলাম।
তারপর ও 'আসছি' বলে কোথায় চলে গেল। এল
না। রাত হল। ওর মা পুকুর থেকে উঠে এসে ভিজে কাপড়ে আমার জন্য চা বসালো। আমি ভয়
পেলাম না। দরজাটা খোলা আমার সামনে। জোনাকি জ্বলছে রাস্তার ঝোপেঝাড়ে। ঝিঁঝিঁ ডাকছে।
আমি উঠে যেতেই পারি। বসে থাকলাম। নিজেকে রাস্তা থেকে দেখলাম। আমার পাশে মশারিটা
গোটানো। সরষের তেলের গন্ধ যেন মশারিটায়।
লোকটা মারা গেল। শুনলাম। টুকরো টুকরো ছবিগুলো জোড়া লাগিয়ে নিজের সাথে নিয়ে
রাখলাম সারাদিন। খুব বৃষ্টি সেদিন। সন্ধ্যেবেলা একা একা ছাতা নিয়ে পুকুর ধারে এসে
দাঁড়ালাম। বাচ্চাদের হুড়মুড়িয়ে স্কুলে ঢোকার মত বৃষ্টি ঝাঁক বেঁধে নামছে পুকুরের
বুকে। বাড়িটা অন্ধকার। দরজার সামনে নয়নতারা গাছটা নুয়ে গেছে জলের দাপটে। একটা
শামুক ধীরে ধীরে ঢুকছে বাড়িটার ভিতরে। বেড়ালটা কই? জানলার
শেডের নীচে কাঁপছে থরথর করে শুয়ে। বাড়ি ফিরে এলাম।
আবার স্বপ্ন দেখলাম। লোকটা ফিরে এসেছে। আমি বসেই আছি। চা খাওয়া শেষ। ওর মা
আমার পাশে বসে। তার ভিজে কাপড়ের জল চুঁইয়ে ফাটা মেঝেতে নদীর মত। লোকটা আমায় বলল,
আপনি আসবেন আমি ভাবতেই পারিনি কোনোদিন। আমি হাসলাম। দেখলাম দরজাটা
বন্ধ। ছিটকিনি নেই কোনো। বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে। বেড়ালটা লোকটার পাশে বসে, যেন শরীরের সাথে মিশে গেছে, চোখদুটো বন্ধ।
No comments:
Post a Comment