মধু
যখন এক কাপড়ে তার সৎ ছেলের ভাড়া বাড়িতে এসে উঠল, তখন সন্ধ্যে। রামরাজাতলার ঘিঞ্জি একটা
গলিতে দুটো ঘর। একটাতে নারাণ আর তার বউ মনু, পাশেরটাতে নাতিনাতনি, দুজনেই কলেজে পড়ছে।
পর
পর ঘর ছ’টা। নারাণের ঘরদুটো একেবারে শেষে। সামনে টানা বারান্দা। একটা টিউবওয়েল। নীচেটা
শ্যাওলা। সাদা থানে জড়ানো পৃথুলা মানুষটার উদ্বাস্তু হওয়াটা অভ্যাস হয়ে গেছে। বয়েস
সত্তর। বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরে ব্যস্ত রাস্তার হাজার রকম আওয়াজ। আজ থেকে দেড় বছর পর পাশের
ঘরের মেঝেতে মাদুরে শুয়ে মধু মারা যাবে। সেদিনই এরকম বৃষ্টি হবে।
কলপাড়ে
হাত-পা ধুয়ে এলো মধু। মনু চা এনে খাটে একটা পেপার পেতে তার উপর রাখল। হাসল। মধুও হাসল।
ঘষা চশমার কাঁচের ভিতর অপরাধী চোখদুটো, কৃতজ্ঞতাতে খুঁটো বাঁধা ছাগলের হ্যাঁচকা টান।
উপার্জন কম। ভাত কম। এবার তার পাতেও ভাত জোগাতে কার ভাগের থেকে কমবে? মধু উঠে নিজের
স্বামীর ছবিতে প্রণাম করল, দেওয়ালে ঝুলছিল, হালকা ধুলোর স্তর উপরে, বাংলাদেশেই মারা
যান।
জানলার কাছে এসে দাঁড়াল মধু। সামনে ব্যস্ত রাস্তা। যে রাস্তা দিয়ে কয়েক মাস পরেই তার
মৃতদেহ নিয়ে যাবে পাড়ার ছেলেরা। বৃষ্টিতে ছাতা হাতে পিছনে পিছনে যাবে নারাণ, রাজীব,
রঞ্জনা। কাঁদতে কাঁদতে যাবে। কিছুটা হাল্কা লাগার জন্য, কিছুটা মায়ায়। কোণের ঘরে তিনমাস
শুয়ে থাকা কলপাড়ের শ্যাওলায় পড়ে কোমর ভাঙা মধুর চিকিৎসার খরচ কি কম? যতটা পারা যেত
নারাণ করত, বাকিটা সেবা দিয়ে পুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত। পাড়ার লোকে বলত, সৎ মায়ের এমন
সেবা!
ঠাকুমা
আর রঞ্জনা শোবে খাটে, রাজীব মেঝেতে। ঘরের মধ্যে বোঁটকা গন্ধ। প্রথম কয়েক রাত ঘুম আসত
না মধুর। তরকারি কাটতে গিয়ে ঝিমোতো, পান সাজতে গিয়ে ঝিমোতো। মনু বলত, থাক না মা! মধু
হাসত। ঘষা কাঁচের মধ্যে পুরো থালা ভাত খাওয়ার আবদার। বায়না। এই বায়নাটা এইবাড়ির সবার।
রাজীব চাকরি পাবে। পেয়েছিল। তখন মধুর ছবিও ঘরে ছিল না, ভেঙে গিয়েছিল সারানো হয়নি। যে
দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে মধু সারারাত বাংলাদেশের পুকুর নদী মাঠ প্রতিবেশীর কথা ভাবত, সেই
দেওয়ালেই কাঠের ফ্রেমে একটা ছবি ঝোলানো ছিল কয়েক বছর মধুর, চন্দনের বিন্দু দেওয়া, পরে
যেগুলো কালো পিঁপড়ের সারি মনে হত।
মধুর
শুয়ে শুয়ে নিজের ছেলের অত্যাচার মনে পড়ত। না খেতে দেওয়া, শাড়ি ছিঁড়ে গেলে কিনে না দেওয়া,
বউমার কটুকথার সারা বুকধরে জ্বালাপোড়ার কথা। অথচ কত টাকা মাইনে ভুবনের। নাতিটা পড়ত
ইংলিশ মিডিয়ামে। যত মনে করত তত মন কেমন করত। মধুর শ্রাদ্ধে সব মিষ্টির ভার নিতে চেয়েছিল
ভুবন, নারাণ দেয়নি। হাঁচড়পাঁচড় করা কান্নাধাক্কা বুক খামচে বলেছিল, মাকে যদি আধপেটা
খাইয়ে রাখতে পেরেছি, তবে সবাইকে অন্তত একটা করে মিষ্টি দিয়েও তার পরলোকে যাওয়ার রাস্তা
করতে আমি পারব।
মধু
কুটনো কুটত, দোতলার ছাদে কাপড় মেলতে যেত, শীতের দিনে বড়ি দিত, বৃষ্টির দিনে আদা চা
করত, একলা কাঁদতে কাঁদতে ভগবানের কাঁথায় আগুন দিতে দিতে সন্ধ্যের শাঁখে ফুঁ দিত।
মধুর
বেডসোরের গন্ধ অনেকদিন ছিল ঘরে। তবু রঞ্জিতা ওই ঘরেই শুতো। কাঁদত একা একা, রাজীব মাথায়
হাত বুলিয়ে বলত কাঁদিস না, মানুষটার চিকিৎসাটাও কি পারছিলাম আমরা? নারাণ কাঁদত ছাদে
একা একা, সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে শুনত মনু। চোখে জল দিয়ে খানিকবাদে লাল চা নিয়ে ছাদে যেত,
লালচোখ তারও।
মনুর
কয়েকদিন ভাতের হিসাবে ভুল হয়েছে। একটু বেশি ভাত খাওয়া গেছে কয়েকদিন অনেকের। পুজোর সময়
ঘরটা রঙ করানো হল। নারাণ নতুন রঙের ঘরে একা শুলো। সামনের দেওয়ালে মধু। ভাই ভুবনের মুখটা
মনে পড়ে। মানুষ এত নিষ্ঠুর। এত নিষ্ঠুর কেন? মধুর ছবির তাকিয়ে তাকিয়ে এই প্রশ্নটা করতে
করতে ঘুমিয়ে পড়ে নারাণ। মানুষ নিষ্ঠুর হয়। কেউ কেউ হয় না। হতে পারে না। হতে নেই বলে
না, ভালোবাসাকে আধমুঠো ভাত না দিয়ে থাকতে পারে না বলেই। নারাণ দেওয়ালের নতুন রঙের গন্ধ
আর ভাতের গন্ধ মিশিয়ে স্বপ্ন বুনতে লাগল। ঘুম এলো। শ্যাওলা পড়া কলপাড়ে একটা বেড়াল লাফাতে
গিয়ে টিনের মগ উল্টে চলে গেল। ঘুম ভেঙে গেল নারাণের। মনুর। ছাদে উঠল। ঘুমন্ত শহরের
উপর ধোঁয়া ধোঁয়া আকাশে আবছা তারার দল। মনু বলল, মা আমাদের দেখছেন। নারাণ বলল, হুম।
No comments:
Post a Comment