Sunday, December 6, 2020

আয়না

আমার নাকের পাশে, ডানদিকে একটা তিল আছে। এই যেমন আয়নায় আমার মুখটা, ভালো লাগছে না? আমার মনে হয় আমায় সুন্দর দেখাচ্ছে। এখনও মনে হচ্ছে। সব সময় মনে হয়।

      তোর হল? আর কতক্ষণ লাগাবি বাপ আমার?”

      মা ডাকছেন। আমার সুন্দরী মা। স্মার্ট মা। মা সব জানেন। সব পারেন। আমরা বিয়েবাড়ি যাচ্ছি। আমার মাসির মেয়ের বিয়ে। বড়মাসির মেয়ে। আমিও মেয়ে, কেউ কেউ জানে, আমার খাট, আমার বালিশ, আমার সাইকেল, যদিও সেটা জেন্টস সাইকেল। আর জানে সাল্লু, আমার ক্লাসেই পড়ে। ক্লাস নাইন, সেকশান বি, রোল বত্রিশ। আমার রোল ছয়।

      আমায় কেমন দেখতে? রোগা, ফর্সা, নাকটা উঁচু, গালটা চওড়া, চোখটা... চোখটা খুব সুন্দর... সাল্লু বলে ঐশ্বর্য রাইয়ের মত। আমিও জানি। কিন্তু কেউ বলবে ভাবিনি কোনোদিন। মাইরি!

      হল তোর?”

      মায়ের চোখে আমি সুন্দর। সব সময় সুন্দর। আবার ভয়। মা জানে আমি অন্যরকম। মা আমায় ভয় পায়। আমি রান্নাঘরে ঢুকলে, মায়ের সাজের বাক্সে হাত দিলে, চোখে কাজল দিলে, আমি হাতটা একটু উঁচু করে হাঁটলে মা ভয় পায়। আমি বুঝি। আমার কষ্ট হত আগে। এখন হয় না। এখন জানি এটাই আমি। সাল্লু আসার পর আরো জানি।

      আমার গায়ে নীল পাঞ্জাবী, একটা চাদর নিয়েছি ওড়নার মত করে। অল্প কাজল দিলাম। সাজব না? কত মানুষ আসবে, শুধু আমার বাইরেটাকেই নিয়ে যাব? আমি যে আমি, তাকে সাজাব না? তাকে অল্প একটু হলেও নিয়ে যাব না? সাল্লু বলেছে সেলফি পাঠাতে। সাল্লু বোঝে আমায়। চেনে আমায়। ওর জ্বর, নইলে একবার সাইকেল নিয়ে ঘুরে যেত বাড়ির সামনে থেকে।

      মা আমার চোখের দিকে তাকালো। বুঝেছে, কাজল দেখেছে। এখন কিছু বলবে না। মায়ের চোখে আবার সেই ভয়টা। বিদ্যুতের মত ঝিলিক খেলে গেল। আমার বুকেও সেই কষ্টটা আবার হল। মরেনি এখনও।

      বাবা গাড়ি বার করেছে। মা সামনে বসবে। আমি পিছনে। বাবা আমায় সহ্য করতে পারে না। আগে পারত। এখন একদম না। কিন্তু কিছু বলে না। কারণ আমি পড়াশোনায় ভালো। পাড়ায় আমার নাম আছে। বাবার অফিসের কলিগদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমার রেজাল্ট সব চাইতে ভালো হয়। বাবা প্রাউড ফিল করে। আবার আমায় নিয়ে অস্বস্তিও। আমি কিরকম ছেলে?

      আমি পিছনের সিটে বসলাম। মায়ের পার্ফিউমের গন্ধ, বাবার ডিও'র গন্ধ মিশে একটা কেমন গন্ধ। এসি চলছে। বাবার হাইসুগার, প্রেশার। মা চিন্তিত খুব। করোনা নিয়ে। আমাদের কারোর মুখে মাস্ক নেই এখন। মায়ের ব্যাগে আছে সবার মাস্ক, স্যানেটাইজার। বাবা মায়ের সঙ্গে মাসির মেয়েকে নিয়ে কথা বলছে। মাসির মেয়ে একবার পালিয়ে গিয়েছিল একটা ছেলের সঙ্গে। সে নাকি ভালো ছেলে না। ভালো চাকরি নেই, সেলসের কাজ করে। মেসোর অনেক জানাশোনা, জোর করে ছাড়িয়ে এনেছে। মাসির মেয়ে আত্মহত্যা করতেও গিয়েছিল। নার্সিং হোমে ছিল চারদিন। সবাই জানত ডায়েরিয়া। আসলে বিষ খেয়েছিল। মাসির মেয়ের বিয়ে হচ্ছে দুবাইয়ের একজন ছেলের সাথে। কি যেন করে সে, আমি বুঝিনি। কিন্তু খুব বড়লোক। কি করে ভুলে গেল সব? আমি সাল্লুর সঙ্গে থাকব, সব সময়, সারাটা জীবন। সাল্লু চাকরি পাক না পাক। আমরা দু'জনে রোলের দোকান করব। আমি ভালো এগরোল বানাতে পারি। ওঃ! এই কথাটা তো আমি বলিই নি না? আমি খুব ভালো রান্না করতে পারি। বললাম না, আমি রান্নাঘরে ঢুকলে মা ভয় পায়! আসলে আগে ভাবতাম মা হয়তো আমায় হিংসে করে, আমার রোল মায়ের রোলের থেকে ভালো হয় বলে। পরে বুঝলাম তা নয়। আসলে মা আমায় ভয় পায়। আমার শরীরকে না, আমার মনকে।

      বাবা মাকে আগের ছেলেটার সম্বন্ধে বাজে কথা বলছে। একটু পর মাসির মেয়েকে নিয়ে আলোচনা হবে। মাসির মেয়েকে নিয়েও বাজে কথা বলবে। মা-ও বলবে। বলবে, অল্প বয়সে শাসন করেনি তো, বাবার অঢেল টাকা থাকলে যা হয়...

      আমার এসব শুনতে ভালো লাগে না। আমি আমার মোবাইলে গান চালিয়ে ইয়ারপ্লাগ কানে গুঁজলাম। আমার লাকি আলি'র গান শুনতে খুব ভালো লাগে। কি দারুণ গলা! সাল্লু লাকি আলির মত গায়। গুনগুন করে গায়। আমি আজ আরেকটা কাজ করেছি। আজ আবার গোঁফ চেঁচেছি। মা খেয়াল করেনি। গোঁফ দাড়িকে আমার খুব ভয়। এমনিতেই আমার গায়ে লোম অনেক বেশি। আমার বন্ধুরা আমায় ভাল্লুক বলে। মেয়ে ভাল্লুক। স্কুলে আমার অনেক নাম --- ছক্কা, লেডিস, বৌদি, ছম্মকছল্লো... এগুলো নাম না আসলে, অপমান। আমার নাম শুভ্রাংশু। আমি আমার একটা নাম দিয়েছি, পারিজাত। এই নামটা আমি আর সাল্লুই জানি শুধু। সাল্লু আমায় এই নামেই হোয়াটস অ্যাপ করে। আমার হোয়াটস অ্যাপ কেন লক করা থাকে এই নিয়েও বহুবার মায়ের কাছে বকা খেয়েছি। কিন্তু কি করে খোলা রাখব? তারপর কার বেশি শরীর খারাপ হবে, আমার না মায়ের? বাবা তো এসবে কথা বলে না... একবার খুব গম্ভীর গলায় বলবে, ছেড়ে দাও না... ও একটা ওয়েস্টেজ... নেহাত পড়াশোনাটা করে... নইলে কে এই মাল ঘরে পুষবে...

      এই নিয়েও একটা গল্প আছে। একবার মা আর বাবা একটা পার্টিতে গেছে। ফিরতে অনেক রাত হবে, বলেই গেছে। আমি বাড়িতে একা। ক্লাস এইটে পড়ি তখন। আমার যে সে কি আনন্দ। মায়ের ঘরে ঢুকলাম। মা আলমারির চাবি কোথায় রাখে আমার জানা। আলমারি খুলে মায়ের বিয়ের বেণারসীটা বার করলাম। সাজের বাক্সটা বার করলাম। তারপর আয়নার সামনে বসে সাজলাম এক ঘন্টা ধরে। কি যে অপূর্ব লাগছিল আমায়, নিজেকে দেখে নিজেই চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। তখন তো আমি সাল্লুকে চিনি না, ও অন্য সেকশানে ছিল। অনেকগুলো ছবি তুললাম। সেভ রাখলাম। সারা ঘর ঘুরে বেড়ালাম। আমার নূপুরের আওয়াজে সারা বাড়ি জেগে উঠল। সারা ঘর কে ঘুরছে? শুভ্রাংশু না, পারিজাত।

      রাতে খেতে ভুলে গেলাম। ওই অবস্থায় সোফায় কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানি না। আমার ঘুম ভাঙল দরজা খোলার আওয়াজে, মায়ের গলায়। বাবা মাতাল। চীৎকার করে কিশোরের গান গাইছে। মা মদ খায় না।

      আমি ধড়মড় করে উঠে বসে মায়ের চোখের দিকে তাকালাম। মা আমার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। বাবা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে, অল্প অল্প টলছে। মা চটাস করে একটা চড় মারল। মায়ের শরীর দুলে উঠল। আবার পার্ফিউমের গন্ধটা পেলাম। এসিটা অন করতে ভুলে গেছি। বাবা ঘামছে। পাখার আওয়াজটা ঝড়ের আওয়াজের মত শোনাচ্ছে। আরো মারতো হয় তো মা, কিন্তু তার আগেই বাবা একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসল। বলল, এ হিজড়ে তুমি পেটে ধরলে কি করে? আমাদের বংশে তো কোনো হিজড়ে জন্মায়নি কোনোদিন... তোমাদের ওদিকে...

      মা চীৎকার করে বাবাকে একটা নোংরা কথা বলল। বাবাও বলল। ব্যস... এখানে আর বসে থাকা যাবে না। আমি শাড়িটা খুলে সোফায় রেখে খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পরে আমার ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। বাবার মুখের মদের গন্ধ আর মায়ের পার্ফিউমের গন্ধটা নাকে লেগে আছে। খিদে পাচ্ছে। বমি পাচ্ছে। কিন্তু কি আশ্চর্য, কান্না পাচ্ছে না। বরং আনন্দ লাগছে। কিসের যেন একটা অজানা আনন্দ। যেন আমার আসল আমিকে ওদের সবার সামনে আনতে পারলাম। কিন্তু হিজড়ে মানে আসলে কিরকম? আমি হিজড়ে দেখেছি, আমি কি ওইরকম? আমার গলার আওয়াজ কি ওইরকম হয়ে যাবে বড় হলে? আমি তো হিজড়ে নই... আমি মেয়ে... আমি কাঁদলাম এইবার... তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম...

      পরের কয়েকদিন বাড়িতে আমরা কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলিনি। চুপচাপ খেয়েছি, স্নান করেছি, একা একা ছাদে ঘুরেছি, নিজের মোবাইলেই অনলাইন ক্লাস করেছি। এরপর থেকে বাবা আমায় আর হিজড়ে বলেনি, ‘মালবলেছে রেগে গেলে।

      মুন্নাদি সাজছে। আমি চুপ করে পাশে বসে আছি। কি দারুণ লাগছে মুন্নাদিকে দেখতে! মুন্নাদি কালো, কিন্তু মুখটা খুব সুন্দর। মুন্নাদি টুকটাক প্রশ্ন করছে আমায়। আমি হুঁ হাঁ উত্তর দিচ্ছি। হঠাৎ একটা ছেলে এলো ঘরে, জিনস আর টিশার্ট পরা। আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখটা নামিয়ে নিলাম। দৃষ্টিটা যেন চেনা। মুন্নাদিকে মেহেদি পরাবে। ছেলেটা আমার মত। আমি তাকিয়েই বুঝে গেছি। ও কি হিজড়ে? না তো। ওর গলার আওয়াজটা কি সুন্দর। আমি মাঝে মাঝেই ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছি। হঠাৎ ও হাতটা বাড়িয়েই বলল, আমার নাম সঞ্জু... লোকে আমায় সঞ্জনাও বলে... তুমি?...

      ঘরে আরো অনেক মেয়ে ছিল। একটা হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল। আমার কানটা লাল হয়ে গেছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, কারণ গরম হয়ে গেছে। সঞ্জু বলে ছেলেটা বলল, তোর কান তো পুরো লাল হয়ে গেছে শুভ্র...

      মুন্নাদি আমার নাম আর পরিচয় বলে দিয়েছে একটু আগেই। আমি মাথা নীচু করেই বসে থাকলাম। হঠাৎ ও আমার হাতটা টেনে বলল, মেহেদি লাগাবি?

      আমি হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ও হেসে বলল, তাকিয়ে আছিস কি? আমি তোর সঞ্জনাদি... বুঝলি? আবার ঘরে হাসির হুল্লোড়। কই সঞ্জনাদির অপমান লাগছে না তো? অপমান খালি কি শুধু ছোটোদের হয় তবে? কিন্তু মাও তো বলে, এটা আমার অপমান... মানে মায়েরও হয়... মা কি বড় হয়নি তবে এখনও?

      আমি হ্যাঁ না বলার আগেই সঞ্জনা আমার হাতে মেহেদি দিতে শুরু করেছে, বাঁ হাতে। একটা ফুল আঁকছে। আমি মনে মনে বললাম, আমি পারিজাত।

      সঞ্জনাদি আমার দিকে বড় বড় চোখ তুলে তাকাচ্ছে। চোখে আর ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি। আমি হাসিটার মানে যেন বুঝতে পারছি। ও আমায় বুঝতে পারছে। আমায় ভালোবাসছে। ওরকম ভালোবাসা সিনেমার মত না, দিদির মত ভালোবাসা। আমার বুকটা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। মাথাটা কেমন শান্ত শান্ত লাগছে। এরকম কেউ তাকায় কারোর দিকে, এত বন্ধুর মত?

      আমার হাতে একটা ফুল আর একটা ছোটো প্রজাপতি আঁকা হল। সঞ্জনাদি আমার কানের কাছে মাথাটা এনে বলল, ফুলটা হলি তুই... আর প্রজাপতিটা হল তোর রাজপুত্র... একদিন ঠিক আসবে দেখবি...

      আমার বুকের মধ্যে যেন কালীপুজোর রাতের মত আকাশ হয়ে উঠল। এত এত বাজি একসঙ্গে জ্বলে উঠল... এত এত আলো... তুবড়ির মত আলো... রঙমশালের মত আলো...

      সঞ্জনাদি আমার গালটা টিপে বলল, আমি ফাঁকা হলে কথা বলব তোর সঙ্গে...

      সঞ্জনাদি চলে গেল। আমি মন দিয়ে আমার হাতের উপর আঁকা ছবিটা দেখছি... হঠাৎ গলার আওয়াজে বুঝলাম মা ঢুকেছে ঘরে। কি আশ্চর্য, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম মা বাবা দু'জনেই আছে ঘরে...

      মা আমার হাতটা টেনে নিয়ে বলল, কে করেছে? মায়ের গলার আওয়াজে সবাই চুপ। মুন্নাদি বলল, মাসি, আমার এক বন্ধু, ওর হাতে কি সুন্দর ফুটেছে না?...

      জানি না মুন্নাদি কথাটা ইচ্ছা করেই বলল, নাকি এমনি বলল। ঘরের মধ্যে আবার হাসির আওয়াজ উঠল, তবে এবার চাপা...

      মা ঠাস্ করে আমার গালে একটা চড় মেরে বলল, চল বাড়ি চল... কোনো বিয়েবাড়ি নেই... তোকে নিয়ে কোনো ভদ্রসমাজে আসা যায় না... তোর বাবা ঠিকই বলে...

      মা আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে বেরোচ্ছে। মা কাঁদছে না। মায়ের গলায় কান্না আর রাগ মিশে একটা আওয়াজ তৈরি হয়েছে। এরকম বাড়িতে অনেকবার হয়। আমি এই আওয়াজটা চিনি। এই সময় মা মারে না। কাঁদে। খালি কাঁদে। আমি মায়ের হ্যাঁচকা টানে যেতে যেতে দেখলাম সঞ্জনা আমার দিকে তাকিয়ে... যেন আমার ভিতর অবধি দেখতে পাচ্ছে এমন চোখ... এমন তাকানো... এরকম হয়? ... আমার কান্না পাচ্ছে... আমায় কেউ বোঝে না... আসলে সাল্লু বলে তো কেউ নেই... বত্রিশ নাম্বার রোল যার সে আমায় রাতদিন বিরক্ত করে... অসভ্যতা করে একা পেলেই... আমি কাউকে বলি না... মা বলেছে বলতে নেই... উল্টে মারতে... আমি পারি না... ওর গায়ে অনেক জোর...

      রাতে আমায় খেতে দিল না কেউ... আমি আমার ঘরে শুয়ে... হঠাৎ আমার হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ ঢুকল...

      Ami sanjanadi... mon kharap hole amay ping koris... ami achi...

 

No comments:

Post a Comment