রাস্তায় জল জমেছে। এতটা জল যে সাইকেলের অর্ধেক টায়ার জলের নীচে চলে যাচ্ছে।
অনুপের নতুন সাইকেল। চেনটা শক্ত। টান লাগছে। কিন্তু
ভালো লাগছে। সব মিলিয়ে ভালো লাগাটাকে ভয়ও লাগছে। একটু পরেই সন্ধ্যে। বিদিশা কই তখন?
বিদিশা সাইকেলের সামনে বসে। কথা বলছে না। বিদিশা
কথা বলে না। এমন অনেকবার হয়েছে অনুপ যা যা বলেছে সব মন দিয়ে শুনেছে। তার দিকে বড় বড়
চোখ করে তাকিয়ে থেকেছে। কিন্তু যেই প্রশ্ন করেছে অমনি চোখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে
বসে থেকেছে। অনুপ চুপ করে বসে সামনের পুকুরটা দেখে, পুকুরের ওপারে বড় আমগাছটা দেখে,
বকের সার বেঁধে ওড়া দেখে, হেলে সাপের চলা দেখে, সব দেখতে দেখতে অনুভব করে বিদিশা তাকে
অনুভব করছে। এটা খুব অদ্ভুত অনুভূতি। কেউ নিজেকে অনুভব করলে সেটাও যে অনুভব করা যায়
সেটা অনুপ জানত না আগে। বিদিশার নিঃশব্দ উপস্থিতি জানিয়েছে। বিদিশা গায়ে পারফিউম জাতীয়
কিচ্ছু মাখে না। কিন্তু ওর গায়ের একটা গন্ধ আছে। নাকে এলে যেন মনটা হ্যাংলার মত হামলে
পড়ে, ওইটুকু বিদিশা তার শরীর মনের ভিতরে ঢোকে। অনেকবার মনে হয়েছে সামনের আমগাছটার নীচে
দাঁড়িয়ে একবার চুমু খায়। ভয়ে বলেনি অনুপ কোনোদিন। কিন্তু বিদিশা আজ অবধি একবারও জোরে
কথা বলেনি। এমনকি এক গল্প দু'বার বলতে গেলে মাথা নীচু করেই বলে, আগে শুনেছি। অনুপের
লজ্জা লাগে। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য না। বিদিশা লজ্জা কাটিয়ে দেয়। কিভাবে দেয় বোঝে
না অনুপ। আসলে বিদিশা তার নিস্তব্ধতায় একটা আকাশ নিয়ে ঘোরে।
বিদিশাকে প্রথম দেখে অনুপ ক্লাস নাইনের শেষের
দিকে। মানে দেখে ভালো লাগে। সেই চোখে দেখে। ক্লাস টেনের মাঝামাঝি চিঠি লেখে। খুব অল্প
কথায় লেখে, "আমার তোকে খুব ভালো লাগে। খুব খুব খুব ভালো লাগে। এক একবার মনে হয়
তোকে না দেখতে পারলে আমি আর বাঁচব না। তুই হয় তো ভাবছিস মিথ্যা কথা বলছি, বাড়িয়ে বলছি,
কিন্তু আমাদের বটতলার কালীমায়ের নামে বলছি, মাইরি, তা নয় রে। তোর যদি আমার উপর কিছু
ফিলিংস থাকে তবে তোকে চিঠির উত্তর দিতে হবে না, তুই শুধু স্কুলের শেষে উৎপলদের বাড়ির
পরে যে পুকুরটা, ওর পাশে যে মনসা মন্দিরটা, সেখানে দাঁড়াস।
বিদিশা দাঁড়িয়েছিল। তবে সপ্তাহ দুয়েক পর। অনুপ
প্রথমে ভেবেছিল অন্য কিছু কারণে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো বিদিশা। অনুপ সাইকেলটা চালিয়ে কিছুদূর
চলেও গিয়েছিল বিদিশাকে দেখেও না দেখার ভাণ করে। আসলে লজ্জা লাগছিল। কিছুদূর গিয়ে মনে
হল যদি তার জন্য দাঁড়ায়? আবার সাইকেল নিয়ে ফিরে এসেছিল। বিদিশা সত্যিই তার জন্যেই দাঁড়িয়েছিল।
শুধু হেসেছিল তার দিকে তাকিয়ে। অল্প একটু।
সেইদিন থেকে আজ চার বছর হল। কটা কথা বলেছে হাতে
গুণে বলে দিতে পারে অনুপ। কেন এত কম কথা বলে? ওর মা-বাবা নেই। মামাবাড়ি থাকে। কিন্তু
এরকম তো কত হয়, তা বলে কি তারা কেউ কথা বলে না? তাই হয় নাকি! তবে?
এই তবেটার কোনো মানে নেই। পুকুরের ধারটায় এসে
থামল অনুপ। মাটি নরম। আজ সকাল অবধি ভীষণ বৃষ্টি হয়েছে। বিদিশা নেমে সামনের চেনা জায়গাটায়
গিয়ে দাঁড়ালো। নীল সাদা ডোরাকাটা চুড়িদার পরে এসেছে। অনুপ সাইকেলটা স্ট্যাণ্ড করে বিদিশার
পাশে এসে দাঁড়ালো। হাতটা হাতের উপর নিল। অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেল। বিদিশা পুকুরের দিকে
তাকিয়ে। অপলক। এত কি ভাবে মেয়েটা? তাকে নিয়ে? তাকে কি বিশ্বাস করতে পারে না? এক এক
সময় বড্ড অভিমান হয় অনুপের। এখন একটু হতে যাচ্ছিল, কিন্তু হল না। কেন হল না? আজ রাতে
টিভিতে ম্যাচ আছে, ইণ্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া, সেই জন্য? হবেও বা। মাথার মধ্যে আজ বিদিশার
সঙ্গে সঙ্গে এই টেনশানটাও কাজ করছে। আজকের ম্যাচটা ভাইটাল। ইন্ডিয়াকে জিততেই হবে যে
করে হোক।
বিদিশা একটু এগিয়ে গেল পুকুরের দিকে। অনুপ এসে
বিদিশার হাতটা ধরল। একটু শক্ত করেই ধরল। মনের মধ্যে ইনসিকিউরিটি কাজ করলে হাতটা শক্ত
করে ধরে অনুপ, আগেও খেয়াল করেছে নিজেকে। কিন্তু কিসের ইনিসিকিউরিটি? জানে না। আর ভাবতে
ইচ্ছাও করছে না। এখন সবটা জুড়ে শুধু বিদিশা থাকুক।
অনুপ বলল, কিচ্ছু বলবি না?
বিদিশা চুপ করে থাকে। ওপারে কয়েকজন স্নান করছে।
অনেক বড় পুকুর বলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কারা। অনুপ আবার বলল, আজকেও চুপ করেই থাকবি?
আজ অনুপের জন্মদিন। বিদিশা জানে। সকালেই হোয়াটস
অ্যাপে উইশ করেছে। শুধু "হ্যাপি বার্থডে, ভালো থাকিস", ব্যস। মিনিমাম একটা
গোলাপের ছবি তো মানুষ পাঠায়!
বিদিশা ঘুরে দাঁড়ালো। সরাসরি অনুপের চোখের দিকে
তাকিয়ে বলল, আমরা এক্ষুণি পালিয়ে যেতে পারি না?
অনুপ থতমত খেয়ে বলল, মানে?
বিদিশা বলল, আজকেই এক্ষুণি, এইখান থেকেই, যদি
আমরা আর বাড়ি না ফিরি?
"কিন্তু কেন?" অনুপ নার্ভাস হয়ে প্রশ্নটা
করল। তার সব সাজানো ঘুঁটি ছড়িয়ে একাকার। যেন ক্যারামবোর্ডে প্রথম ধাক্কাতেই কেউ রেড
ঘুঁটিটা ফেলে দিয়েছে পকেটে। বাকি কালো-সাদা ঘুঁটিগুলো তার দিকে তাকিয়ে। অনুপ স্পষ্ট
চিনতে পারছে না। তার হাতের স্ট্রাইকারটাও যেন নড়ছে না।
"আমি আর পারছি না তাই", বিদিশা তার
দিকে স্থির তাকিয়ে। এমন স্থির দৃঢ় আবেগহীন চোখ অনুপ দেখেনি কোনোদিন।
"কেন পারছিস না? কি পারছিস না?" অনুপের
গলায় অধৈর্য।
বিদিশা তার অনেক কাছে এগিয়ে এসে আচমকা নিজের জামার
উপরের দিকটা নামিয়ে বলল, দেখ।
বিদিশার গায়ের রঙ খুব ফর্সা। তার স্তনের উপরের
দিকে দুটো লাল দাগ। স্পষ্ট দাগ।
অনুপ কিছু বোঝার আগেই বিদিশা বলল, বড়মামা…..
দু'জনে হেঁটে ফিরেছিল। বিদিশা সাইকেলে ওঠেনি।
তাকে জোর করার ইচ্ছাও করেনি অনুপের। তার সব কিছু থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। সব কিছু
থেকে। একা। ক্যারামবোর্ডে শুধু কালোঘুঁটি। তার হাতের স্ট্রাইকারটা অবধি তার নেই।
আর কোনোদিন কথা হয়নি বিদিশার সঙ্গে অনুপের। অনুপ
ছ-মাস পরে একজন 'স্বাভাবিক' মেয়ে পেয়ে গেছে। বাবা নেই। মা আছে। সে কথা বলে, চুমু খেতে
দেয়, ঘনিষ্ঠ আদরে নিরুৎসাহ করে না। মাঝে মাঝেই অবশ্য বিদিশার আধখোলা বুকের লালদাগটা
মনে পড়ে। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তবু নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানায় যে বিনা ঝঞ্ঝাটে বেরিয়ে
আসতে পেরেছে সম্পর্কটা থেকে। প্রথমে ভেবেছিল বিদিশা আত্মহত্যা করবে। ভয় পেত। কিন্তু
যখন অনুপ দেখল বিদিশা সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করল না তখন রাগ হতে শুরু করল বিদিশার
উপর। ওকেও খারাপ মনে হত। যেন ইচ্ছা করেই ওসব করায় ও।
একদিন বিদিশার বিয়ে ঠিক হল। বিদিশা নিজে এল বিয়ের
নেমন্তন্ন করতে। অনুপ তখন চাকরির পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত। সুজানার বাড়ি থেকে চাপ আসছে।
এমন সময় বিদিশা এল কার্ড নিয়ে। বেশি কথা বলল না। দু-একটা সৌজন্যমূলক কথা বলে উঠতে যাবে,
অনুপ জিজ্ঞাসা করল, "তোর হবু বর জানে?"
অনুপের বুকের মধ্যে কেমন একটা বেলেল্লাপনা আনন্দ
হচ্ছে। মনে হচ্ছে দেখি আর কি কি করিয়েছিস কাকে কাকে দিয়ে…
বিদিশা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর কি মনে
হয়?
অনুপ বলল, বলিস না কিছু…. যা আছে তা তোর আর আমার
মধ্যেই থাক... আমি কাউকে বলছি না….
অনুপের অবাক লাগল নিজেকে। সে যেন নিজের অজান্তেই
বিদিশার হবু বরকে ঈর্ষা করছে, যেন হেরে গেল সে সেই অজানা পুরুষটার কাছে। এখনই বিদিশাকে
জড়িয়ে বিছানায় ফেলে সারা শরীর কামড়ে লাল করে দিতে ইচ্ছা করছে, বড়মামার দাঁতের থেকেও
লাল। সবাইকে চীৎকার করে জানিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে... এই দ্যাখো... দেখে যাও…..
বিদিশা বলল, তুই শুনতে চাস?….
অনুপ বুঝতে পারল না কি বলবে। বিদিশা কেন বুঝল
না যে সে দুর্বল হতে পারে কিন্তু আসলে সে সৎ। সে যে কাউকে কিচ্ছু বলবে না এই প্রতিশ্রুতিকে
এত খেলো করে দেখার স্পর্ধা পায় কোথা থেকে একটা নষ্ট মেয়েছেলে!
বিদিশা বলল, সব জানে…..
অনুপ বলল, ও...
অনুপ মনে মনে বলল, এ মিথ্যাকথা..
বিদিশা বলল, আসি রে, আসিস... সুজানাকে নিয়েই আসিস...
পার্থ তোকে একবার দেখতেও চেয়েছে….
(ছবি: Suman)
No comments:
Post a Comment