প্রতিবার ভোটে কোনো না কোনো একটা শব্দ প্রাধান্য পায়। এবারের
শব্দ হল 'বহিরাগত'। অ্যাদ্দিন শুনছিলাম শুধু পদ্মে আসীন মুখেরাই বহিরাগত। আজ খবরের
কাগজ খুলে দেখছি তা তো নয়, দেখছি ঘাসফুলের এদিকে ওদিকেও বহিরাগত।
খুব সমস্যায় পড়লাম। আচ্ছা বহিরাগত
শব্দের বিপরীতে কি শব্দ আছে, অন্তর্গত? অন্দরমহলের লোক? কাছের মানুষ?
এ সবই বড় গোলমেলে শব্দ আসলে। কে যে
বাইরের আর কে যে ভিতরের সব ঘেঁটে তালগোল পাকিয়ে একাকার হয়ে যাবে যে!
আর তাছাড়া ভালো করে ইতিহাস নেড়েচেড়ে
দেখলে তো সবই বহিরাগত। ভারতের কত মানুষ যে বাইরে থেকে এলো আর রয়ে গেল। সেই যে গো কবিতায়
আছে না?
"হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায়
দ্রাবিড় চীন.. শক-হুন-দলপাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন...."
তারপর আবার সারদাদেবীর বাণী আছে না,
"কেউ তোমার পর নয়, জগতকে আপনার করে নিতে শেখো।"
সুতরাং ভারতে বাস করে বহিরাগতর হিসাব
কষা ভারি মুশকিলের কথা। কদিন আগে, মানে করোনার আগে, এই বহিরাগত আর অন্তর্গত গোনার হিড়িক
উঠেছিল না? কিসব আন্দোলন হল। মায় জয় গোস্বামী অবধি মঞ্চে দাঁড়িয়ে কি এক সুরে 'ক্যা
ক্যা ছি ছি' বলেছিলেন!
ভীষণ মুশকিল বুঝলেন। কে যে কার কাছের
মানুষ, কে যে কার মনের মানুষ, কে যে কার দুচক্ষের বিষ - এ হিসাব করতে পারবেন না। এই
দেখে গেলেন এ এদিকে দাঁড়িয়ে। তারপর মুখ আঁচিয়ে একটা ঢেকুর তুলে এসে দেখলেন সে সেদিকে
দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কারোর বুকে বা ঘাড়ে মাথায় রেখে, আর সে বলছে, এই তো
তুমি আমাদের ভালো দলে চলে এলে, তুমি ভালো ওরা খারাপ। যে দল বদলালো সে আসলে রবীন্দ্রনাথের
সেই গানের কথা বলছে, "যে ছিল আমার স্বপনচারিনী, তারে বুঝিতে পারিনি তারে বুঝিতে
পারিনি....তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে....গো..."
রবীন্দ্রনাথ সব লিখে গেছেন। এ কথাটা
বড়রা বলেন না? দেখুন এমন একটা এদিক-ওদিক খেলা নিয়েও লাইন আছে। তবে শঙ্করাচার্যও কি
বলেননি? বলেছিলেন তো, পদ্মপাতায় জলের বিন্দুর মত জীবন চঞ্চল, এই আছে এই নেই....কিন্তু
পার্টি নিয়ে বলেছিলেন কি? ভাবতে হবে।
আর একটু দার্শনিক মতে ভেবে দেখুন,
সেই যে গো গানটা, সে গান বিবেকানন্দ খুব গাইতেন, "মন চলো নিজ নিকেতনে, সংসার বিদেশে
বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে"।
এই গান শুনে আমার এক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার
আত্মীয় চমকে উঠে বলেছিলেন, মানে? একি গান! এতো খুব মুশকিলের কথা! মানে আমার ফিক্সড
ডিপোজিট, রেকারিং, নানা স্কিমে নানা খাটানো টাকা, সব সব সব কিনা বিদেশে? তাও হয়? না
না এসব গান শুনে কাজ নেই বাবা।
আমিও ওসব গানের কথা তুলতে চাই না।
তবে এই বহিরাগত শব্দটায় বড় দার্শনিকভাব জেগে ওঠে কিনা, সেই গান, "ভেবে দেখ মনে
কেউ কারো না...দু তিনদিনের জন্যে ভবে কর্তা বলে সবাই মানে, সেই কর্তারে দেবে ফেলে কালাকালের
কর্তা এলে."
হ্যাঁ গা, এই কালাকালের কর্তাটি কে?
মানে সে আবার লালকেল্লার গাঁ থেকে আসে না তো? কে জানে বাপু!
আর সব শেষ কথা হল, এ অভিজ্ঞতা কতজনেরই
না হয়েছে, ভোট দিতে গেলেন, শুনলেন আপনার ভোট আগে কেউ একজন দিয়ে দিয়েছে, মানে আপনি ভোটের
ময়দানে এখন বহিরাগত! হরি হরি, এ যে কি জ্বালা। তখন দাঁতমুখ খিঁচাতে খিঁচাতে বাড়ি ফেরা,
কে বাবা তুই আমার এত আপন হলি, আমার হয়ে ভোটের বোতামখানা চিপে গেলি....ওরে আমার বিধিব্যবস্থা
কই গেলি কই গেলি....
No comments:
Post a Comment