উত্তর কলকাতার ঘটনা। আমার এক আত্মীয়া থাকতেন
সেখানে। আমি ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে প্রায়ই যেতাম সপ্তাহান্তে। বড় হয়ে একাই
যেতাম ওনার বিশাল লাইব্রেরীর আকর্ষণে। ওনাদের বাড়ির কটা বাড়ি পরেই ছিল বুলু
পিসিদের বাড়ি। আমার মজা লাগত ওদের ছাদটা দেখতে। খোলা ছাদ, মাঝে দোলনা আর বাইরে
থেকে ওঠার ঘোরানো সিঁড়ি। ওই দোলনা আর ঘোরানো সিঁড়ির উপর যে আমার কি টান ছিল বলা
যায় না। কিন্তু আমাদের ও বাড়ী যাওয়া নিষেধ ছিল। নিষেধের কারণটা কেউ বলতেন না, শুধু
এক মুখ গাম্ভীর্যতা নিয়ে সবাই বলত, না। আমার মনে হত হয়তো কোনো ভূত আছে ওদের বাড়ি,
আমি ছোট বলে আমায় যেতে দিচ্ছে না আর ভয় পাব বলে বলছেও না। একটা জিনিস আরো খেয়াল
করতাম ওনার সাথে পাড়ার আরো কেউ তেমন কথাও বলতেন না। উনিও বলতেন না। তবে রাস্তায়
দেখা হলে আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখতাম, ভাবতাম কি সাহস! ভুতের সাথে একা থাকেন। উনি
মিষ্টি করে হেসে আমার গাল টিপে দিতেন।
আসল কথায় আসি। আমি রোজ দেখতাম একজন জেঠু (কারোর মাথায় অল্প সাদা
চুল থাকলেই আমি জেঠু বলতাম, যেহেতু আমার জেঠুর অল্প পাকা চুল ছিল) সকালবেলা খবরের
কাগজ নিয়ে ওই ছাদে ওঠেন। দোলনার মুখোমুখি একটা বেতের চেয়ারে বসেন। বুলু পিসিও একটা
কাগজ নিয়ে ওনার সামনে দোলনায় বসেন আর চা খান। ঘন্টাখানেক পর জেঠু চলে যেতেন। আমি
কিছু জানতে চাইলেই, যেমন, "ওই জেঠু কে? পিসির বাড়ি কেন আসেন..." এসব
প্রশ্ন সবাই পাশ কাটিয়ে যেতেন।
আজ জানি সব কথা। আমার আত্মীয়ার কাছে শুনেছিলাম সব। বলি।
ওই জেঠু তখন প্রেসিডেন্সির ইকনমিক্সের ছাত্র আর বুলু পিসি বাংলার।
দু'জনের আলাপ, তারপর প্রেম। বাড়ির কেউ জানতেন না। কলেজ জীবন শেষ হয়ে শুরু হল
জীবিকার জীবন। খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন নাকি জেঠু। চাকরি পেতে দেরী হল না। পেলেন
সরকারী চাকরি রাজ্য সরকারের। বাড়িতে জানালেন বুলু পিসির কথা। শুরু হল তুমুল
অশান্তি। জেঠুরা ছিলেন উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ তায় বাংলাদেশের কোন জমিদার বংশের
পুরোহিত। ওনার বাবা বলে দিলেন, ওই মেয়ে বাড়ির বউ হলে উনি জেঠুকে ত্যাজ্যপুত্র
করবেন। জেঠু তাই মেনে নিলেন। কিন্তু বুলু পিসি বললেন, "না।" বললেন,
"তুমি বাড়ির এক ছেলে। বাংলাদেশ থেকে এসে অনেক কষ্টে তোমার বাবা পরিবারটা দাঁড়
করিয়েছেন। এ তুমি করতে পার না।" ব্যস, সব শেষ।
এরপর পিসি পেলেন স্কুলের চাকরী। দু'জনে ব্যস্ত রাখলেন নিজেদেরকে
নিজেদের জগতে। দিন গেল। দু'জনের কেউ বিয়ে করলেন না। বিয়ে নিয়ে খুব অশান্তি হত নাকি
বুলু পিসির বাড়িতে। কিন্তু উনি একচুলও ওনার সিদ্ধান্ত থেকে সরলেন না। এরপর ওনার
মা-বাবা গত হলেন। ভাই গেলেন বিদেশে। আর ফিরলেন না। জেঠুর বাবাও গত হলেন কালের
গতিতে।
তখন দু'জনের বয়সই চল্লিশের কোটায়। আবার দু'জনের একসাথে যাত্রা শুরু হল। জেঠু রোজ
সকালে আসতে লাগলেন বাজার নিয়ে আর কাগজ নিয়ে। ছাদে বসেন, চা খান, ঘন্টাখানেক বাদে চলে
যান। ব্যস ওইটুকুই, তাও দিনের আলোয় সর্বজনসন্মুখে। তবুও পাড়ায় নিন্দা হল, কুৎসা
হল। ওরা নীরব রইলেন। ধীরে ধীরে সব থিতিয়ে গেল। ওনারা নীরব রইলেন। না চাইলেন কারো
বন্ধুত্ব, না গুরুত্ব দিলেন কারোর উপেক্ষার।
আমি আমার আত্মীয়াকে জানতে চাইলাম, "তুমি এত কথা জানলে কি
করে?"
উনি হাসলেন। আমার সামনে টেলিফোনটা নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন। ওপাশ থেকে
রিসিভারটা তুলতেই বললেন, "বুলু তুই বাড়ি আছিস, আজ প্রশান্ত আসবে?... আচ্ছা
আমি আমার ভাইপোকে নিয়ে বিকালে আসব।"
আমার মনের অবস্থা লিখে বোঝানো দায়। বললাম, "তুমি চেনো ওনাকে?
মানে এতদিন বলো নি কেন?"
আমার পিসি হেসে বললেন, "আমার শাশুড়ির ভয়ে। বুলুর সাথে আমার
আলাপ সেই ওর বাড়ির অশান্তির সময় থেকে। ওকে খেতে দিত না। বাড়িতে আটকে রাখত। আমি
লুকিয়ে খাবার দিয়ে আসতাম। সে কি দৃশ্য তুই কল্পনাও করতে পারবি না। পিঠে মারের দাগ,
সারা শরীরে দুটো হাড় বই কিছু নেই। ভাবতাম মানুষ এত সহ্যও করতে পারে! বলতাম, তুই মর
বুলু, তুই মর।" পিসির গলা বুজে আসল, দুচোখ ছলছল করে উঠল।
কিছুটা সামলে নিয়ে বললেন, "তবে জানিস, যেদিন প্রশান্তকে
দেখলাম সেদিন বুঝলাম কিসের জোরে বুলুর এত জোর। সেদিন থেকে বুঝলাম বাবু(আমি)
ভালবাসতে শরীর লাগে না রে, শুধু হৃদয়খানাই যথেষ্ট যদি তেমন মানুষ জোটে কারোর
অদৃষ্টে।"
তারপর আরো কথা হয়েছিল। শুনেছিলাম জেঠু আবার বিয়ের কথা বলেছিলেন
নাকি। কিন্তু বুলু পিসির জবাব ছিল একই, "না, তোমার বাবার আত্মা কষ্ট পাবেন।
এই বন্ধুত্বটুকুই থাক।" আমি কল্পনা করার চেষ্টা করতাম কথাগুলো বলার সময় ওনার
মুখের ভাব কিরকম হয়েছিল। চোখের কোণায় জল এসেছিল, গলা কেঁপেছিল? জানি না। তবে আমি
বুলু পিসির সাথে দেখা করতে যাই নি কোনোদিন। কেন বলতে পারব না। হয়তো মনে হয়েছিল মহৎ
জিনিসকে দূর থেকে দেখাই ভাল। মাঝে মাঝে অতিপরিচয়ের আড়াল মহৎকে ছোট করে ফেলে নিজের
অজান্তেই। সে ক্ষতি আমি মেনে নিতে পারব না। তাই দূর থেকেই সেই ছাদের প্রতি
ধূলিকণাকে আমার প্রণাম জানালাম। আজও অসময়ে সময়ে মনে ভাসে একটা ছাদ, দুটো মুখ, আর
কিছুটা জুঁই ফুলের গন্ধ, বুলু পিসির বাড়ির বাগানে ছিল।
No comments:
Post a Comment