শরৎকালের সকাল। গুরু
বসেছেন ধ্যানে। তাঁর সেবক ব্যস্ত আশ্রমের নানাবিধ কাজে। চারিদিকে শান্ত স্নিগ্ধ
পরিবেশ। কাজ সেরে শিষ্য বসলেন আশ্রমের দাওয়ায় আসন পেতে। মগ্ন হলেন ধ্যানে।
"মহারাজ", সেবক তাকালেন, সামনে করজোড়ে দু'জন যুবক।
"আমরা প্রভুর দর্শনপ্রার্থী মহারাজ। বহুদূর থেকে আসছি।"
"অভিলাষ?", স্মিতমুখে জানতে চাইলেন সেবক।
"দীক্ষা মহারাজ।"
ভিতরে গিয়ে জানালেন সেবক গুরুকে। আগত দু'জনের ডাক পড়ল ভিতরে।
গুরু বসে স্থির আসনে, প্রসন্ন শান্ত তাঁর মুখ, করূণাময় দু'চোখ।
"দীক্ষা চাও?"
"হ্যাঁ প্রভু।"
"কেন?"
"বড় জ্বালা প্রভু। চাই মুক্তি। সংসার যে বিষ!"
"বিষও না, অমৃতও না। সংসার সংসারই। তুমি থাক সংসারে, সংসার তোমাতে না থাকলেই
হল।"
মাথা নীচু করে রইলেন দুই দীক্ষাপ্রার্থী।
কিছুক্ষণ কাটল নীরবে।
গুরু নিরীক্ষণ করলেন দু'জনকে। তারপর বললেন, "বেশ। দেব আমি দীক্ষা। তবে এক
বৎসর থাকতে হবে আশ্রমে। রাজী?"
একবাক্যেই রাজী হয়ে গেলেন দুইজন। বাড়ীর কাজ মিটিয়ে এক বৎসর আশ্রমে থাকার
সঙ্কল্প করে ফিরলেন।
"কি হবে সাধন গুরু?"
"বিশেষ কিছুই না। যা আশ্রমের কাজ তাই করবে। আমার সেবক শিখিয়ে দেবে সব। শুধু
থাক শরণাগত।"
শুরু হল তাদের আশ্রমিক জীবন। সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি নানাবিধ কাজ। তারই মাঝে
ভগবানের নাম-গূণকীর্তন।
দিন যেতে লাগল। প্রথমজন হয়ে উঠতে লাগল শান্ত, প্রসন্নচিত্ত। আর দ্বিতীয়জন হতে
লাগল তার বিপরীত। সবেতেই তার অভিযোগ।
"এ কোথায় এলাম ভাই! এ তো এক সংসার ছেড়ে আরেক সংসারে আসলাম। কই গুপ্তমন্ত্র,
কই গোপন সাধন-প্রণালী? আমার আর সইছে না।"
"ধৈর্য্য রাখ ভাই। তিনি বলেছেন শরণাগত থাকতে। অশান্ত হোয়ো না।"
অর্ধবৎসর অতিবাহিত হল। সেবক লক্ষ্য করলেন প্রথমজন সারাদিন কি আনন্দে থাকেন মগ্ন।
তিনি মালা গাঁথেন, ঝাঁট দেন দেবালয়, বাসন মাজেন আর গুন গুন করে করেন গান।
অন্যদিকে দ্বিতীয়জন হয়ে উঠেছেন ক্ষুব্ধ, নীরব। চুপচাপ বসে থাকেন, মাঝে মাঝেই
পড়ে দীর্ঘশ্বাস। আর বলেন, হা ভগবান। সে ডাকে না আছে সুর, না আছে আকুতি।
বৎসর পুরোলো। প্রথমজন পেলেন দীক্ষা। দ্বিতীয়জন ফিরলেন শূন্য হাতে।
সেবক জানতে চাইলেন,"এমন কেন হল প্রভু? দুজনকেই তো দিলেন একই নির্দেশ। একজন
পেল পথ, আরেকজন গেল হারিয়ে! কেন প্রভু?"
গুরু হাসলেন। বললেন, "বৎস, বিশ্বাসবিহীন শরণাগতি শুধুই নিশ্চেষ্টতা। প্রথমজন
চেয়েছিলেন গতি, তাই মুক্তিকে তিনি বাঁধন থেকে মুক্তি জেনেছিলেন।
দ্বিতীয়জন চেয়েছিলেন পালাতে, তাই মুক্তিকে তিনি অখন্ড অবসর ভেবেছিলেন। যেমন ভাব
তেমন লাভ, মনে রেখো।"
শিষ্য গুরুপাদপদ্মে প্রণতি জানিয়ে আসলেন মুক্ত আকাশের নীচে। শূন্য আকাশ তাঁর
বিশ্বাসে হল পূর্ণ।
No comments:
Post a Comment