বলা হয় আমাদের ধর্মে, দর্শনে ব্যবহারিক দিকটা তেমন গুরুত্ব পায়নি যতটা
পেয়েছে তার ভাবের দিকটা। কথাটা কিছুটা
সত্য তো বটেই। সে নিয়ে অনেক
লেখা, আলোচনা ভাষণ আছে। সে থাক। বরং দুটি মূল ব্যবহারিক দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ব্যবহার
প্রধানত দু প্রকার। এক, অন্যের সাথে আমার ব্যবহার। দুই, নিজের সাথে নিজের ব্যবহার। এবং অবশ্যই এরা নিজেদের মধ্যে সম্পর্কিত, অর্থাৎ একের প্রভাব অন্যতে পড়ে।
অন্যের সাথে আমার ব্যবহারের রকম অজস্র। যেমন অফিসে, বস - কলিগ (শত্রুপক্ষ + মিত্রপক্ষ + সুবিধাবাদী
পক্ষ + উদাসীন পক্ষ ইত্যাদি) - ক্লায়েন্ট - বয় ইত্যাদি। অন্যদিকে পরিবার তো মহাভারত। এরপর পাড়াতুতো,
ক্লাবতুতো,
ট্রেনতুতো হাজার রকম মানুষ আর হাজার রকম ব্যবহার।
এসবের
মধ্যে ব্যালেন্স করে চলতে গেলে আমাদের শাস্ত্রমতে দুটো ব্যবহার পদ্ধতি খুব
প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় রোজকার জীবনে। এক, শ্রদ্ধা; দুই, সন্তুষ্টি।
শ্রদ্ধা
অর্থাৎ একটা পজিটিভ অ্যটিটিউড। ভাগবতে
আছে, প্রহ্লাদজীকে
হিরণ্যকশিপু পাঠিয়েছেন দৈত্যদের টিউটোরিয়ালে। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের সিলেবাস কিছুতেই পছন্দ না প্রহ্লাদজীর। সে নিয়ে তো রোজ অশান্তি।
এদিকে
প্রহ্লাদজীর ব্যবহারের এমন এক মাধুর্য্য যে তাঁর সহপাঠীরা ধীরে ধীরে তাঁর প্রতি
অনুরক্ত হতে শুরু করেছেন। কিন্তু হলে হবে
কি, গুরুর ভয়ে আর
কিছু বলতেই পারেন না।
একদিন
হল কি, দৈত্যগুরু গেলেন
কি কাজে শহরে। ব্যাস, ছাত্রদের আর পায় কে। সবাই ধরে বসল প্রহ্লাদজীকে। তারা জানতে চায়, কি তাঁর মনোভাব? কেন তিনি এত অত্যাচারিত হয়েও নিজের
বিশ্বাসের ওপর এত অটল? আর
সর্বোপরি কি এমন তিনি উপলব্ধি করেছেন যে তাঁর মুখে এমন স্বর্গীয় প্রসন্নতা!
প্রহ্লাদজী
তাদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। শিক্ষা
দিলেন সংসার, জগৎ, ঈশ্বর ইত্যাদি সম্বন্ধে। কিন্তু সব শেষে বললেন দারুন একটা কথা। তিনি বললেন- দেখো, পরমাত্মা সব খানে, সব সময়ে, সব অবস্থায় বিরাজমান। তাঁকে প্রসন্ন করতে তোমায় কোন যাগযজ্ঞ বা সুকঠিন তপস্যা করতে
হবে না। তুমি শুধু সবার
প্রতি শ্রদ্ধাটা রেখো তোমার আচরণে। ব্যস
তা হলেই হবে। তিনি সন্তুষ্ট। আর যিনি সব, তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে তোমার
কিসের অভাব?
কি
আশ্চর্য কথা! অথচ এই দেশেই লক্ষ টাকার প্যান্ডেল, লক্ষ টাকার মন্দির, ধর্মের নামে শোষণ পীড়ন আরো কত কি! বাপ রে বাপ! কে
শেখালো এসব? দৈত্যগুরু?
সে
যাক। এই হল শ্রদ্ধা। আচরণ ভিন্ন হোক, কিন্তু মূল সুরটা যেন একই থাকে, শ্রদ্ধা। পরমহংসদেব এই ব্যবহার পদ্ধতিকেই বলতেন 'বাঘ নারায়ণ', দুর থেকে প্রণাম করার কথা।
যেমন আমাদের কান শোনে শব্দ, মন সেই শব্দে পায় সংগীত। আমাদের চোখ দেখে আকার, মন সেই আকারে দেখে ছবি। এই সংগীত, ছবি যেমন বাইরে কোথাও নেই, তা আমারই মনের প্রতিফলন। তেমনই পরমাত্মাও বাইরে কোথায়? তা তো আমারই শ্রদ্ধার প্রতিফলন। যা আমার মনের কেন্দ্রেই আছে। একেই পরমহংসদেব বলতেন চোখে ন্যাবা
লাগলে সব হলুদ দেখানোর কথা।
এই
শ্রদ্ধাবোধ কি দেবে আমাকে? দেবে
সংসারের সব চাইতে মূল্যবান সম্পদ- সন্তোষ। মানে
সমঝোতা না, মানে মেনে নেওয়া
না। এর মানে নিজের
জায়গাটা খুঁজে পাওয়া আর নিজেকে খুঁজে পাওয়া একই সাথে।
যেমন
ধরা যাক কোন সংগীত শিক্ষার্থীকে এমন একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হল যেখানে সব ধরণের বাদ্য
রাখা। সে বিভ্রান্ত
হবে, অশান্ত হবে - কোনটা
তার নিজের যোগ্য যন্ত্র!
এটা
ওটা নাড়তে চাড়তে একদিন সে নিজের যন্ত্রটা আবিস্কার করবে। তখন সে হবে সন্তুষ্ট। আর
শুরু হবে তার সাধনা। তাই আমাদের
শাস্ত্রকারেরা বলেছেন যে দেখো,
সন্তুষ্টি হল সাধনার গোড়ার কথা। বাইরের দেখাটা মিটবে যখন, ভিতরের দেখা শুরু হবে তখন।
আচ্ছা
সন্তুষ্টির প্রধান শত্রু কে?
লোভ। আবার ভাগবতে আসা
যাক। যুধিষ্ঠিরের
সাথে নারদজী সংসারের বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করছেন। বলছেন- দেখ বাবাজীবন, সংসারে কাম, ক্রোধ ইত্যাদির একটা না একটা প্রশমনের উপায় আছে। যেমন ধরো, কাম মেটে স্ত্রীসঙ্গে, ক্রোধে কিছুটা শান্ত হয় রাগী কথা (মানে
গালাগাল আর কি) ইত্যাদির মাধ্যমে। কিন্তু
লোভের কোন উপশম নেই। ত্রিভুবন পেয়েও
লোভ থামতে চায় না। কি ন্যায্য কথা!
সেকালেই কি, আর
একালেই কি।
আচ্ছা
এই লোভ জন্মায় কি করে? সোজা
উত্তর- তুলনা করে। ওর আছে আমার নেই। ব্যাস হয়ে গেল। ঘুম গেল, খাওয়া
গেল। ভাল কথা গেল, সাদা হাসিটা গেল; সোজা না তাকিয়ে আড়চোখে তাকানো শুরু হল। প্রতিবেশী গাড়ি কিনল। আমি সরাসরি বললাম না, "কি দারূন!"
আড়চোখে তাকালাম যাতে সে বুঝতে না পারে, পারলেই তো আমি ছোট হয়ে গেলাম। তার থেকে আড়চোখে দেখব আর মনে বলব, "আচ্ছা! খুব দু'নম্বরি পয়সা হয়েছে না!" সাথে
বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে গরম দীর্ঘশ্বাস! হায় রে।
তুলনা
একটা ঘোর। অন্ধ করে দেয়
বিবেচনা শক্তিকে। তার একমাত্র ঘোষণা-
"আমারও চাই", ব্যস। যোগ্যতা আছে কি না বা প্রয়োজন আছে কি
না- এসব প্রশ্ন সে জানতে চায় না। কি
করে চাইবে! ওটা যে মিথ্যা প্রবৃত্তি। সীমাকে
মর্যাদা দেওয়া তো সত্যের স্বভাব। 'তুলনা' তো একটি অর্থহীন, দিশাহীন মিথ্যা। তাই তার নিজের যোগ্যতা বা সীমা বোঝার আবশ্যকতাই নেই। ইংরাজীতে একটা কথা আছে, Comparisons are odious. খুব
খাঁটি কথা।
আমার
সস্তা জুতোর সাথে খগেনের দামী জুতোর তুলনায় আমার যে কষ্ট, তোমার একতলা বাড়ির সাথে নরেনের পাঁচতলা
বাড়ির তুলনায়ও তোমার সেই কষ্ট। পার্থক্যটা
বস্তুতে, ভাবে একই। পুরোটাই সময়ের আর শক্তির অপচয়।
তাই
শেষে নারদজী বললেন, যে
মানুষ সংসারে সন্তুষ্ট হতে পেরেছে, সে সংসারের কাঁটাবনে জুতো পায়ে হাঁটছে। সন্তুষ্টির জুতো, নির্লোভত্বের জুতো। তুলনা ত্যাগ করো, শ্রদ্ধাশীল হও।
এই হল আত্ম-ব্যবহার। নিজেকে প্রশ্রয় না দেওয়ার। নিজেকে মুক্ত করার অভ্যাস। প্রতিদিন অল্প অল্প করে। এতেই
জন্মাবে সুখ, মিলবে
শান্তি।
এই
ভাবটিকেই ঈশোপনিষদ তাঁর প্রথম শ্লোকে সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করছেন,
ঈশাবস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধ: কস্যস্বিদ্ধনং।।
বিশ্বসংসারকে ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত দেখিবে, কারোর সম্পদে লোভ করিবে না, ত্যাগের* দ্বারাই ভোগ করিবে।
*নিরাসক্তিই
সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ (স্বামীজি)।
No comments:
Post a Comment