Sunday, September 7, 2014

খণ্ড ও অখণ্ড

এক ঘটি জল পুকুর থেকে তুলে পাড়ে রাখলাম কি ঘরে আনলাম। 

     কেউ বলল তাকে ঘটির জল আবার কেউ বলল পুকুরের জল। দুজনেই সত্যি। তবে যে বলল পুকুরের জল সে আরেকটু বেশি সত্যি। 
     আমার যে চেতনা, তা খণ্ড চেতনা। মূল যে অখণ্ড চেতনা তার অংশ। তাই কেউ বলল, "এ হলাম আমি", আবার কেউ বলল, "হে অখন্ড আমি তোমার অংশ। তুমি প্রভু, আমি দাস"

     এই ক্ষেত্রেও দুজনেই সত্যি। তবে দ্বিতীয় জন বেশি সত্যি। 
     পৃথিবীর সব কটি প্রধান ধর্মের মূল সুর হল আমাকে এই অখণ্ড সত্তাটিকে অনুভব করতেই হবে। না হলে আমার মানুষ হয়ে আসাটা পূর্ণতা পাবে না। ব্যর্থ হবে। 
     সব ধর্মগুলির ফেরার পথের যে দিশা আছে প্রধাত তা দুই ধারার। এক, জ্ঞানের পথ। দুই, ভক্তির পথ। 
     সে বিষয়ে যাওয়ার আগে একটু খণ্ড চেতনার দিকে তাকানো যাক। 
     আমার আমি এই খণ্ড চেতনা। সে যা সত্যি বলে জানে তাও তাই খণ্ড সত্যিই। কারণ খণ্ড সত্যি দিয়ে অখণ্ড সত্যকে জানা সম্ভব না। ঠিক যেমন এক ফালি জানলা দিয়ে পুরো আকাশ দেখা সম্ভব না। তাই আমার আকাশে রামধনু দেখা গেলেও তোমার আকাশে শুধুই কালো মেঘ। কারণ আমরা একই সময়ে দুটো ভিন্ন জানলা দিয়ে দুটুকরো আকাশ দেখছি।
     এই ঘটনাকেই অন্ধের হস্তি দর্শন ঠাকুর বলতেন। কয়েক জন অন্ধ হাতি দেখতে গেল। হাত দিয়ে ছুঁলো। কেউ বলল থামের মত, সে পা ধরেছিল। কেউ বলল সরু, সে লেজ ধরেছিল। এরকম কেউ শুঁড়, কেউ মাথা ইত্যাদি ধরে তার মতই বর্ণনা করতে লাগল। 
     এই হল খণ্ড চেতনার উপলব্ধ খণ্ড সত্য। এতে দৈনন্দিন জীবন চলে যায়। এতে বিজ্ঞান, সাহিত্য, নীতি বোঝা যায়। সব বেশ চলেই যায়। কিন্তু গোল বাধে তখন যখন হঠাৎ কোন এক মুহুর্তে তার মনে প্রশ্ন আসে, "আমি কে?" 
     ব্যস তার সব গুলিয়ে গেল। তার চারিদিকে সব অর্থহীন লাগতে লাগল। পাগল হল। একে শাস্ত্রে বলে বৈরাগ্য, তীব্র বৈরাগ্য।
     সে জনে জনে জিজ্ঞাসা করে ফেরে, "হ্যাঁ গো এ কোন পুকুরের জল তোমার ঘটে, আমার ঘটে।"
     লোকে বলে, "ও কি আহম্মকি কথা, পুকুরের জল কেন হতে যাবে, এতো আমারই ঘটের জল"
     সে মনে মনে বলে, "না গো না, এ আমার না। তুমি ঘুমিয়ে আছো।", সে পথ খোঁজে। পুকুরে যাওয়ার পথ, মিলনের পথ। 
     এবার দুই পথের কথায় আসা যাক। প্রথম জ্ঞান। এ পথকে অভাবের পথ বলা হয়। ভাব অর্থাৎ emotion. এই ক্ষেত্রে বিচারই হল আসল। মূল কথা হল- বাবা, ঘটখানি দুদিনের জন্য। আজ বা কাল ভাঙবে। তুমি সেই অখণ্ড পুকুরের জল। নিজেকে ঘট ভাবা বন্ধ করো। অর্থাৎ দেহাত্মভাব কদাপি না। ভাবো আমি সেই অখণ্ড চেতনার অংশ।
     বেশ কঠিন পথ। গীতায় ভগবান বলছেন, বাবা দেহধারী হয়েও দেহকে অস্বীকার করা চাট্টিখানি কথা না। পথে কিছু ভুল নেই। তবে কঠিন, এই যা।
     রামকৃষ্ণ দেবেরও তাই মত- কলিতে অন্নগত প্রাণ, ভক্তিপথই ভাল। 
     অতএব ভক্তিপথ। এখানে ঘট ভাঙা বা অস্বীকার করার কথা না। ঘটটিকে পুকুরের মধ্যেই স্থাপন করার কথা। বিশ্বাসের কথা, ভাবের কথা, ভক্তির কথা। 
     আমি রইলাম ঘট নিয়েই তোমার মধ্যে। এ ঘট তোমার বানানো প্রভু। তোমার ইচ্ছা রাখো কি না রাখো। আমি শুধু জানি আমার ঘটের সব জল তোমার, আমি রইলাম তোমার মাঝে তোমার হয়ে। 
     এ হল লীলার কথা। ভক্ত গান বাঁধল, স্তব রচনা করল, মালা গাঁথল। যুগে যুগে পৃথিবীর দিকে দিকে এঁরা এসেছেন, আছেন আর আসবেনও। সুফী থেকে বাউল, খৃষ্টীয় প্রেমিক সাধক থেকে ফকির সব প্রেমে পাগল। মরমী হয়ে মানুষকে অমৃতের স্বাদ মর্মে দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর গান দিয়ে জীবন দিয়ে।
     তাঁদেরই শরণাগত হই। পুকুরে নামব তাঁদের হাত ধরে। 
     শাস্ত্র বলেন, ভক্ত কৃপা হরি কৃপা থেকে শক্তিশালী। তাই তাদেরই পথ চেয়ে বসে। কার পায়ে সে পুকুরের পাড়ের মাটি লেগে খুঁজছি। যেতে তো হবেই। 
     তাই দুয়ারে বসে গাই- 
                       "আমারে কে নিবি ভাই সঁপিতে চাই আপনারে" 



     কেউ তো আসবেনই এ পথে, যাব তার সাথে পুকুরে। 

No comments:

Post a Comment