রুমের
চাবিটা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললাম, "রোহিতকে ডিনারটা রুমেই দিতে বলবেন বিকাশদা।"
বিকাশদা
এই হোটেলের মালিক। ছোটো হোটেল। রাতের দিকে রিসেপশানে বিকাশদাই থাকেন। আমায় অফিসের কাজে
তিন-চার মাস অন্তর আসতেই হয়, এই ব্লু হেভেনে।
রোহিত
ডিনার নিয়ে এল রুমে। বললাম, "বিকাশদার মুখটা অত ফ্যাকাসে লাগছিল কেন রে? জ্বরটর
হয়েছিল?" রোহিত মাথা নেড়ে চলে গেল। 'হ্যাঁ' বা 'না' কিছুই বলল না। অবাক লাগল।
কিন্তু ক্লান্ত শরীরে ভাবনা দাঁড়ায় না। ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরেরদিন
সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল, উঠে কাগজটা পেলাম রুমের দরজার তলায়। রোহিত জানে এটা আমার
পুরোনো অভ্যাস। সকালে চায়ের আগে কাগজ।
গতকাল
ভোরে ব্লু হেভেন হোটেলের মালিক বিকাশ দত্ত (৫৮) ও হোটেলের অনেক পুরোনো কর্মচারী রোহিত
পালের (৩৯) গলা কাটা দেহ পাওয়া যায়। কোনো বৈষয়িক বিবাদের জেরেই খুন মনে করা হচ্ছে।
ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে বডি দুটো। পুলিশের বক্তব্য, ময়না তদন্তের পরই জানা
যাবে খুনের সময় ইত্যাদি ইত্যাদি...
আমার
রুমটা বাইরে থেকে আটকানো। অনেকবার টেনেও খুলতে পারলাম না। জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম।
রাস্তায় কেউ নেই। জানলা দিয়েই দেখলাম লাল ফিতে দিয়ে হোটেলের চারদিক ঘেরা। কোলাপ্সেবেল
গেটটাও দেখা যাচ্ছে, বাইরে থেকে তালা দেওয়া। আমার ঘাম হচ্ছে। মাথাটা ঘুরছে। পাখাটা
চলছে না। মোবাইলটা অফ্। অন্ হল না।
আবার
জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। চীৎকার করে ডাকতে গেলাম জানলা দিয়ে। কিন্তু গলাটা তো আমার
না! বিকাশদার, কি করে? কেন? কি হচ্ছে এগুলো? আমি চীৎকার করে বললাম, "আমার স্ত্রী
রত্না আমায় খুন করিয়েছে, বিল্টুর জন্য, রোহিত বাধা দিতে এসেছিল বলে ওকেও। বিল্টু আমার
হোটেলেরই ম্যানেজার। সেই থেকেই..."
আমি
সম্পূর্ণ বিকাশদার গলায় কথা বলছি। কিন্তু কেন? কি করে? আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম, আমি
কই? আমার মুখটা সম্পূর্ণ বিকাশদার। এই তো মোটা গোঁফ, এই তো চোখের নীচে কাটা দাগ, বিকাশদা
নকশাল করতেন।
'খটাং'
করে আওয়াজ। রোহিত দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে। আমার হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে। রোহিত চলে গেল আমার
দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে।
আমি
বাইরে এলাম। টানা সরু বারান্দা। নীচে কিছুর একটা আওয়াজ হচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নামছি। কিন্তু
আমি তো নামতে চাইছি না। তবু নামছি। কেউ টেনে হিঁচড়ে নামাচ্ছে।
লকার
খোলা। হাতড়াচ্ছে একজন মহিলা। মাঝ বয়েসী। আমার হাত-পা কাঁপছে। আমার নামার শব্দে ফিরে
বিস্ফারিত চোখে তাকালো মহিলা। আমার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হল, "রত্না!"
কি
বিচ্ছিরি হিসহিসে আওয়াজ। আমি সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। মহিলা দেওয়ালের সাথে সিঁধিয়ে গেছে।
আমি বিড়বিড় করে কিসব বলে যাচ্ছি। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে যাচ্ছি। মহিলা চীৎকার করতে
চাইছে, পারছে না। মুখটা হাঁ হয়ে আটকে আছে। চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসবে এক্ষুনি।
রোহিত
কিচেনের থেকে বেরিয়ে এল। হাতে একটা মাংস কাটার ছোরা। আমি চোখ বন্ধ করতে চাইলাম। পারলাম
না। ফিনকি দিয়ে রক্ত আমার টি-শার্ট ভিজিয়ে দিল। কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছে মহিলা মেঝেতে
পড়ে। আমার হাতে ছুরিটা শক্ত করে ধরা। আমি ছাড়তে পারছি না।
হঠাৎ
কোলাপ্সেবেল গেট খোলার আওয়াজ হল। আমি নড়তে পারছি না। বুটের আওয়াজ পাচ্ছি। আসছে। আমি
জানি কারা আসছে। তবু নড়তে পারছি না। আমার পায়ের নীচে মৃত শরীর। খালি পায়ে গরম রক্তের
ছোঁয়া। আমার সামনে ততক্ষণে পুলিশ।
পুলিশ
আমায় কিছু জিজ্ঞাসা করছে। আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না। কারণ শোনার মত অবস্থায় নেই আমি।
পুলিশের সাথে এসেছে বিল্টু। ফ্যালফ্যালে চোখে রত্নার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
ওর মুখটা বদলে যাচ্ছে। আমি বারবার বলতে চাইছি, ওদিকে তাকান, অফিসার, ওদিকে, ওদিকে..বলতে
পারছি না। মুখ চেপে ধরে আছে কে। বিল্টুর মুখটা রোহিতের মত হয়ে যাচ্ছে, আমি দেখছি। পুলিশ
কিছু বোঝার আগেই বিল্টু ওরফে রোহিত পুলিশের রিভলবারটা বার করে নিজের মাথায় চালিয়ে দিল।
পাশাপাশি
দুটো মৃতদেহ। আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না। আমার ভিতর থেকে একটা দমকা হাসি আসছে। আমি
হাসছি... হো... হো... হো...
No comments:
Post a Comment