('অরুচি' এবং 'মনটারে তুই বাঁধ' গল্পের শেষ পর্ব)
(নন্দা ও তার স্বামী পারভেজের কথোপকথন। নন্দা অফিসের কাজে বাইরে, পারভেজ বাড়িতে)
- হ্যালো, পারভেজ আমি পৌঁছে
গেছি।
- ফ্লাইটে অসুবিধা হয়নি তো?
- না, শোনো একটা কথা আছে, আমার কাজের সাইটে নেটওয়ার্কের প্রবলেম হয় বলছে লোকাল ম্যানেজার..আমার
একটা অনুরোধ...
- শুনছি, তার আগে শোনো, খারাপ নেটওয়ার্কে কথা বলা স্বাস্থ্যকর নয়, তুমি মোবাইল বন্ধ
করবে, আমি আল্লার কাছে দোয়া করব তুমি কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো...
- আমিও ঈশ্বরের কাছে তাই চাই... আচ্ছা শোনো না...
- তার আগে বলো, তুমি কি অফিসের গাড়িতে?
- হুম, কেন?
- আরাম করে বসেছ?
- হুম
- খেয়েছ?
- না গিয়ে খাব, চা-বিস্কিট খেয়েছি।
- তোমার আশেপাশে কি খুব সুন্দর দৃশ্য?
- দারুন, কেন?
- তুমি খুব সুন্দর, তোমার আশেপাশের প্রেক্ষাপটটা জানলে তোমায় আরো সুন্দর করে কল্পনা
করতে পারি..
- হয়েছে... এবার একটু শোনো প্লিজ, আমি নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাব নইলে...
- বলো।
- সুতপা হয় তো তোমায় ফোন করতে পারে। ড্রিংক করেও করতে পারে। ও খুব ডিপ্রেসড। তুমি প্লিজ
ওর সাথে কথা বোলো একটু, শুনছো...
- শুনছি।
- জয়ন্ত আবার মেরেছে ওকে, আরো কিছু যা আমি তোমায় বলতে পারব না, আজ ভোরে উঠে আমায় মেল
করেছে, আমি ফরোয়ার্ড করে দিয়েছি তোমায়, প্লিজ একটু পড়ে নিও... আজ কি কলেজে অনেক চাপ
তোমার?
- না, পড়ে নেব।
- তুমি কথা দাও ওকে বোঝাবে ও যেন অন্তত একবার আমাদের সাথে এসে থাকে।
- চেষ্টা করব, তুমি ফোনে কথা বললেই আমার তোমায় চুমু খেতে ইচ্ছা করে...
- শুরু হল, তুমি বাথরুম, ঘরদোর গোছাতে যেও না... সময় মত খেয়ে নিও, রান্নার দিদিকে আমি
কবে কি রাঁধতে হবে বলে গেছি...
- তুমি খুব সুন্দর মানুষ নন্দা, আল্লার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা যে আমি তোমায় পেয়েছি, যদিও
আমি তোমার যোগ্য নই, কারণ তোমার মত করে সব মানুষকে ভালোবাসতে পারি না, আমি বড্ড বিচার
করি।
- তুমি জানো এগুলো শুনলে আমার কান্না পায়...
- কেঁদো না, সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে যাও। মোবাইল অফ্ করে দাও।
- টাটা---
- টাটা।
ল্যাণ্ডফোনে
রিং হচ্ছে। দোতলা থেকে পারভেজ সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে নামল। ডান হাতের তর্জনীটা
একটা বইয়ের শরীরে ঢোকানো। বইটা খুব আদর করে ধরা।
- হ্যালো।
- হ্যালো, আমি সুতপা বলছি, নন্দার মোবাইলটা বন্ধ, ওকে একটু পাওয়া যাবে?
- জ্বী না, ও তো বাড়ি নেই, বাইরে আছে, মোবাইলে কিছু নেটওয়ার্কের সমস্যা হচ্ছে বলে ফোন
বন্ধ রাখতে বলেছি। নেটওয়ার্ক না পেলে মনের উপর ফোনের চাইতে বেশি চাপ পড়ে।
- আচ্ছা, আপনি কি পারভেজ স্যার? আমি সুতপা, নন্দার অনেকদিনের বন্ধু।
- আমি চিনি আপনাকে। আপনি এখন জয়ন্ত মশায়ের সাথে বাইরে আছেন, আপনি ফোন করতে পারেন নন্দা
আমাকে বলেছে। আপনি মদ্যপান করে ফোন করতে পারেন এ-ও বলেছে। আর বলেছে, আপনাকে খুব ডিপ্রেসড
দেখলে আমি যেন আপনার সাথে একটু কথা বলি। আমার মনে হচ্ছে আপনি মদ খেয়ে আছেন, আর আপনি
ডিপ্রেসড, তাই আপনি যদি চান আমি আপনার সাথে পঁচিশ মিনিট কথা বলতে পারি।
- পঁচিশ মিনিট কেন?
- কারণ আমার মনে হয় একজন মানুষের মন ভালো করার ইচ্ছা থাকলে কেউ তার সাথে পঁচিশ মিনিট
কথা বললেই মন ভালো হয়ে যায়। এর বেশি বললে, জাবর কাটা হয়। মানুষের পক্ষে জাবর কাটা খুব
অস্বাস্থ্যকর।
- আমি কথা বলতে চাই।
- বেশ, আমি তবে চেয়ারটা টেনে নিই, মানুষ বসে কথা বললে ভালো করে কথা বলে, দাঁড়িয়ে কথা
বললে অন্যমনস্ক হয় বেশি। আপনি হাতের কাছে ইতিমধ্যে জলের জায়গা রাখুন, কারণ আপনার কান্না
পাবে মাঝে মাঝে, জল খেলে আবেগ কমতি হয়, কথা বলতে পারবেন।
- আচ্ছা
- বলুন।
- আপনি জয়ন্তকে চেনেন তবে?
- হ্যাঁ, অত্যন্ত খারাপ মানের লেখক, সেন্টিমেন্টাল সুড়সুড়ি।
- আমি খুব খারাপ মানুষ। আপনি জানেন?
- খারাপ নন। তবে ভালোও নন। ও দুটোই খুব অবাস্তব কথা। কোনো মানুষ নিজেকে নিজে দেখতে
পায় না। নিজের ব্যবহারে টুকরো টুকরো করে নিজেকে চেনে। এই যেমন আমি এখন মেদিনীপুরের
ইতিহাসের উপর লেখা একটা বই খুব আদর করে জড়িয়ে আছি, যেহেতু বইটা আমার বাবার লেখা, তাই
এই মুহূর্তে আমার নিজেকে একজন ভালোবাসাময় মানুষ মনে হচ্ছে। এখনি আমি যদি দেওয়ালে একটা
মাকড়সা দেখি আমার মধ্যে একটা হিংস্র ভীতু সত্তা জেগে উঠবে। তখন আমি আর ভালোবাসাময় থাকব
না, সে মাকড়সাটা তেড়ে এলে হয়ত এই বইটা ছুঁড়েই তাকে মারব।... আপনি হাসছেন... আপনার হাসিটা
সুন্দর... জ্বী আপনার গলার আওয়াজটাও মিষ্টি... আপনি গানও খুব ভালো করেন শুনেছি... না
আমি আপনার কন্ঠের আওয়াজে কামার্ত হচ্ছি না...
- আপনি কলেজে মনস্তত্ত্ব পড়ান?
- জ্বী।
- আমার কি জয়ন্তকে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ?
- আপনি চান আমি বলি, হ্যাঁ। তবে আপনি বলবেন, কেন আপনি ছাড়তে পারবেন না। আর যদি বলি,
না, আপনি তখন জয়ন্তকে নিয়ে অনেকগুলো খারাপ কথা বলবেন, আর নিজের ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েনের
কথা শোনাবেন... বাই দ্য ওয়ে আপনার মেয়েকে দেখতে খুব সুন্দর... ওর জন্যে আমার একরাশ
ভালোবাসা রইল... তাই আমি উত্তর দেব না।
- আপনি ভীষণ নিষ্ঠুর। আচ্ছা আপনি জানেন নন্দা চায় আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি, ওর
মত সুখী হই... আচ্ছা ওকি সত্যিই সুখী? না সুখে থাকার ভান করে?...
- নন্দা বোকার মত ভালোবাসে। মানে আবেগপ্রবণ ভালোবাসা। যারাই আবেগপ্রবণ ভালোবাসে তারাই
চায় সারা জগতে সবাই তার আবেগের মত হোক। চাওয়াটায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু চাওয়ার পরিণামটা
ভালো হয় না। আজ দেখছেন না দেশ জুড়ে যে ধর্মের নামে গোলমাল, সে এই আবেগের ভালোবাসার
জন্য।
আপনার আরেকটা প্রশ্নের উত্তর, হ্যাঁ নন্দা সুখী। সুখে থাকাটা নির্ভর করে... আপনার চারদিকে
ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে শুনছেন? আপনি চাইলে এই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনেও সুখী হতে পারেন...
সারারাত মগ্ন থাকতে পারেন... আর আমি তো একটা আস্ত ভালো মানুষ, নন্দার অসুখী হওয়ার কারণ
নেই। ঠাট্টা করছিলাম। আসলে সুখী হতে গেলে নিজের দুঃখটাকে আগে স্বীকার করে নিতে হয়।
- আমি কি নিইনি?
- না, আপনি আসলে মানুষটা ভীতু। হয়ত লোভী। একই কথা। নইলে দুঃখ থেকে পালাতে চাইতেন না।
জয়ন্ত আপনাকে ব্যবহার করছে, আপনি জানেন, কিন্তু জয়ন্তকে আপনি সে অর্থে ব্যবহার করতে
পারছেন না, আপনি ওকে ভালোবেসে ফেলেছেন। আসলে ওর দুর্বলতাকে জেনে ফেলে আপনি আরো বেশি
করে ভালোবেসে ফেলেছেন, মেয়েদের এটা স্বভাব। আপনি একজন ভালো মানুষ।
- লোভী, স্বার্থপর...
- এগুলো ঘটনা, আপনি চাইলেই পাল্টাতে পারেন। আপনি কাঁদছেন। জল খান। আমাদের আর দশ মিনিট
আছে।
- আমি কি কোনোদিন বেরোতে পারব না?
- আপনি চাইলেই পারবেন। জোর করবেন না। স্বাভাবিক থাকুন। চাইলে ভোরের ট্রেনে অসংরক্ষিত
কামরাতেই চলে আসুন। একজন মানুষ যতটা খারাপ মানুষে ভরা পৃথিবীটাকে ভাবে আসলে ততটা খারাপ
মানুষ এখনও হয় নি। কারণ মানুষ খারাপটাও চায় ভালো হবে জেনে। পরে ভুলটা বুঝতে পেরে সত্যিকারের
ভালোটাকে চায়।
- আমি রাখছি। আমি বেরোব।
- জ্বী, ভালো থাকবেন।
দশ মিনিট পর, আবার রিং।
- হ্যাঁ বলেন সুতপা।
- কি করে জানলেন আমিই?
- মানুষ তো জন্তুই। সব জন্তুর মধ্যে একটা ইনস্টিংক্ট থাকে --- কার কাছ থেকে তার ক্ষতির
আশঙ্কা নেই, আর কার থেকে আছে, সেটা সে বোঝে। সেই না ক্ষতির আশঙ্কাতেই সে থাকতে চায়।
ভালোবাসাটা অনেক সময় সেখান থেকেও জন্মায়।
- হুম...
- আপনি ফিরে যান। আমি দোয়া করব আপনার জন্য।
- আমি তো আল্লাহ-ঈশ্বর কোন কিছুতেই বিশ্বাস করি না।
- আমি করি। তাই আমি দোয়া করব। আপনি বেরোন। জয়ন্ত খারাপ মানুষ। যে ঠকায় সে খারাপ, অল্প
খারাপ। যে ঠকিয়ে কষ্ট না পেয়ে নিজেকে যুক্তি দিয়ে আড়াল করে সে খুনীর চাইতেও খারাপ।
আপনি একজন অত্যন্ত খারাপ মানুষের সাথে আছেন। বেরিয়ে আসুন, ওনার দুর্বলতার ফাঁদে পা
দেবেন না আর।
- আমি আপনার কাছে আসব।
- অবশ্যই আসবেন, মেয়েটাকে নিয়ে আসবেন।
- নন্দা খুব ভাগ্যবান। আমার হিংসা হচ্ছে।
- নন্দা আমাকে খুব ভালোবাসে, আমি ততটা পারি না। কিন্তু ওকে ছাড়া আমি বাঁচার কথাও ভাবতে
পারি না। কষ্ট হয়। যে মানুষ সবটা দিয়ে ভালোবাসে সে ভাগ্যবান। সেই অর্থে আমিও নন্দাকে
হিংসা করি। ও সুখী। আমি নই। আমি ওকে দেখে শিখি। পঁচিশ মিনিট হয়ে গেছে। আপনি এখন অনেক
ভালো। এখন বেরিয়ে সোজা মেয়েকে নিয়ে আসুন এখানে। নন্দাও কাল বিকেলের ফ্লাইটে ফিরবে।
পারভেজ
মেল করল নন্দাকে,
তুমি,
সুতপার
সাথে কথা হল। মনে হল একটা ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঝোড়ো হাওয়ায় আমি একা দাঁড়িয়ে
শুনলাম ওর কথাগুলো। ও কাল আসবে। মানে তুমি যখন পড়বে, আজ। তুমি আসার সময় ওর মেয়েটার
জন্য একটা সুন্দর পোশাক এনো, আমাদের বুকে আল্লাহ যে স্নেহ দিয়েছেন আমরা তা ওই নিষ্পাপ
শিশুটিকে দেব। আমরা সুতপাকে বোঝাব ওর বাচ্চাটার সংস্পর্শে আমরা সন্তানহীন দম্পতি ভীষণ
খুশী। ও তা হলে নিজেকে আমাদের বোঝা মনে করবে না।
তাড়াতাড়ি
এসো। তোমায় অনেকক্ষণ না দেখলে আমার নিজেকে বেবুন মনে হয়। তুমি জানো।
তোমার
আমি
No comments:
Post a Comment