Tuesday, July 23, 2019

মনটা রে তুই বাঁধ


এগজিকিউটিভ লাউঞ্জে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে দু'জন। একজন ষাটোর্ধ পুরুষ; আরেকজন, বয়েস থাক, যুবতীই বলা চলে। পুরুষ মানুষটি জিন্স আর সাদা টি-শার্ট, আর যুবতী একটা নীল পাঞ্জাবি আর জিন্স। আমার আগের গল্প - 'অরুচি' যদি পড়া থাকে, তবে চেনা যায়, এরাই হল জয়ন্ত, স্বনামধন্য লেখক ও সুতপা।
লাউঞ্জটা ফাঁকা ফাঁকাই।
- ফ্লাইটটা হল না, না?
- চেষ্টা করেছিলাম, হল না... হাসলে?
- তুমি শ্রীলেখাদি'র (জয়ন্ত'র স্ত্রী) ভয় পেয়েছিলে। এয়ারপোর্টে তোমায় ড্রপ করতে আসত, কিন্তু স্টেশানে কোনোদিন আসবে না, একে বাত, দুই অনেকটা দূর। তাছাড়া...
- কি?
 
- একটু স্নব তো তোমাদের ফ্যামিলির সবাই। তোমার মনে নেই, বুবুন (জয়ন্তর ছেলে) যখন বাইরে যাচ্ছিল, আমার হাতে স্যামসাং-এর অ্যান্ড্রয়েডটা দেখে বলেছিল, এইবার একটা আইফোন নাও সুতপাদি, ক'দ্দিন আর মিডিল ক্লাস গেজেটে থাকবে?
- খেয়ে এসেছ?
- হুম। একবার আমরা ফ্লাইটে গিয়েছিলাম, তখন শ্রীলেখাদি বুবুনের ওখানে ছিল, মনে আছে?
 
- আচ্ছা এসব কথার কি খুব দরকার?
- ট্রেন কত দেরি বলো তো? আর একটু তাতিয়ে দিলে আদরটা বেশি পায় জানো তো...
- উফ, কি যে করো, বাচ্চামিটা গেল না, একটু সরে বসো, জানোই তো চেনাজানা চারদিকে...
- তো? সবাই জানে আমি তোমার..
দু'মিনিট চুপচাপ দু'জনেই। মোবাইলে খুটখাট করতে করতে সুতপা মোবাইলটা জয়ন্তর চোখের সামনে ধরল, "এই মেসেজটার দরকার ছিল?"
      'শেভ করে নিও'
- আচ্ছা, শ্রীলেখাদিকে এই কথাটা বলার সাহস হয়েছে তোমার কখনও?
- সাহস না, ইচ্ছা, সব কথা সবাইকে বলা যায় না। সুতপা, তুমি জানো, কিন্তু কেন মাঝেমাঝে এরকম অবুঝের মত কথা বলো বুঝি না।
- তোমার বোঝা না বোঝায় কিচ্ছু আসে না জয়ন্ত, এরকম একটা মেসেজ মাঝরাতে আসা মানে কি? আমার পাশে আমার বর-মেয়ে শুয়ে... হাসলে যে?... ও বুঝেছি... ব্যঙ্গ... তাচ্ছিল্য...
 
      বাই দ্য ওয়ে, শেভ করেছি। তুমি বলার আগেই দুপুরেই শেভ করেছি, করব না? তুমি আমার বই এত নাম করা প্রকাশনী থেকে বার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছো... প্রোমোট করতে নিজে এসেছ.... আমি এতটা তো নেমকহারাম নই বলো?... সামান্য শেভ করে আসতে পারব না তোমায় খুশী করার জন্য? তাও কি হয়...
- কোনো সিন ক্রিয়েট কোরো না প্লিজ...
- ভয় নেই টিস্যু পেপার আছে... এনেছি... গতবারের মত তোমার কাছ থেকে রুমাল চাইব না... তাও আবার প্রকাশ্যে....
চুপচাপ। মোবাইলে হোয়াটস অ্যাপে ব্যস্ত জয়ন্ত, সুতপা উঠে দাঁড়িয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষের আনাগোনা। প্রচণ্ড গরম বাইরে। লোকেদের হাসফাস করা দেখছে, মেঝেতে শুয়ে বসে থাকা হাজার হাজার পরিবার দেখছে... মধ্যবিত্ত ভারতবাসী... নিম্নবিত্ত... ভিখারি ভারতবাসী... ক'জন মানুষ এরকম লাউঞ্জে থাকার সুযোগ পায়?... তার নিজের যোগ্যতাও কি আছে পাওয়ার? বড্ড লোভ... বড্ড লোভ ভালোভাবে বাঁচার... চুমকিকে ভালো স্কুলে পড়ানোর, বড় করার... জানে অবশ্য তার নিজের বা বরের সে সামর্থ্য নেই। আবার এসে বসল জয়ন্তর পাশে।
- আচ্ছা, তুমি এইমাসে চুমকির স্কুলের জন্য কিছু এক্সট্রা পাঠাতে পারবে? 
- কত?
 
- হাজার ছয়, ড্রেস বানাতে হবে... জানোই তো এইসব স্কুলগুলোর যা বায়নাক্কা।
 
- দেখছি...
- আচ্ছা তুমি সবসময় 'দেখছি' বলো কেন? (গলায় ঝাঁঝ) তুমি এই 'দেখছি' শব্দটা দিয়ে বুঝিয়ে দাও আমি তোমার কাছে কি সাংঘাতিক ঋণী, ভিখারি...
- উফ, কি হয়েছে তোমার আজ? এই... দাঁড়াও দাঁড়াও... তোমার পিরিয়ডের সময় এগিয়ে আসেনি তো? এত মুড সুইং কেন হচ্ছে তো বলো তো? ওভাবে তাকিয়ে আছ কেন? তোমার কথা অনুযায়ী এই ডেটটায় টিকিট কেটেছি, ডুবিও না কিন্তু, সে বার উটিতে গিয়ে যা খেল দেখালে... উফ্...!

      সুতপা উঠে কাঁচের দেওয়ালের কাছে দাঁড়ালো। জয়ন্ত কথাগুলো প্রায় মোবাইলে চোখ রেখেই বলে গেল। সুতপার সামনে যদিও হাওড়া স্টেশানের প্ল্যাটফর্ম, লক্ষ লক্ষ মানুষ, কিন্তু সুতপার চোখ ঝাপসা... কাঁচের দেওয়ালে নিজের ছবি.... আবছা ছবি... পাশে এসে যেন চুমকি দাঁড়ালো... আরো অস্পষ্ট, বুকের কাছে দলা পাকানো কান্না...
পিঠে হাত... "চলো প্ল্যাটফর্ম দিয়ে দিয়েছে..."
      সুতপা টিস্যু পেপারে চোখের কোণাটা কাজল বাঁচিয়ে মুছল... একটু হেসে বলল,"ভয় নেই, এটা পিরিয়ডসের নয়... এমনি... ডেট এ মাসের শেষে... কুড়িদিন ধরো প্রায়..."
      লাউঞ্জ ফাঁকাই প্রায়। সুতপার ব্যবহার করা টিস্যু পেপারটা ঝাঁ চকচকে মেঝেতে পড়ে। মিনিট দু'য়েক পরে ডাস্টবিনে ঝেঁটিয়ে ফেলে দিল একজন।

      এসি টু টায়ার। মুখোমুখি দুটো লোয়ার বার্থে দু'জনে। হোয়াটস অ্যাপে কথোপকথন।
- অ্যাকাউন্টটা চেক করো, পাঠিয়ে দিয়েছি 😘
- মেসেজ ঢুকল এখনই
 😘😘
- তুমি জানো আমি পাবলিক প্লেসে একটু নার্ভাস ফিল করি... সরি... আই ওয়াজ রুড ট্যু ইউ... ট্রাইং টু শো মাইসেল্ফ স্মার্ট।
- জানি, অ্যাকচুয়ালি ইউ ফিল গিলটি অলয়েজ উইথ মি অ্যাট ফার্স্ট... আই নো... লাভ ইউ...
- মি টু...
 ...আমার অনেক লিমিটেশান আছে সুতপা, তুমি জানো। আমার একটা সংসার আছে, রেপুটেশন আছে, তুমিও আছো... এগুলো ব্যালেন্স করা এত ইজি নয় সুতপা।
- আমি জানি, তবু ইমপালসিভ হয়ে পড়ি। আসলে আমরা দু'জনেই আমাদের গিলটি ফিলিংসটা থেকে বাঁচার জন্য একটা ডিফেন্স মেকানিজম তৈরি করি জয়ন্ত, তুমি আড়ষ্ট হও, রুড হও, আমি হয়ত একটু বেশি ইমপালসিভ হয়ে পড়ি... মানুষ তো... সামাজিক জীব... সামাজিক জীব অপরাধবোধ ছাড়া হয় না...
- নাইস লাইন
 👍
- থ্যাংকস।
- আমার ইচ্ছা তুমি কিভাবে মাছ কেনো তা দেখব জানো? মানে মাছ বাছার সময় তোমার চোখদুটো কেমন হয়...
- কেন ফুলের বাজারে যেতে ইচ্ছা করে না, আমি কিভাবে ফুল দেখি দেখতে?
- মাছই ড্রেসিং করে পাতে দিতে হয় জয়ন্ত, ফুল তো তা নয়, বাগান থেকেও খোঁপায় দেওয়া যায়।
 
- শেভিং কথাটা এত বড় ইস্যু কেন হচ্ছে তোমার?
- ইস্যু নয়, ইনসিকিউরিটি, যদি কোনোদিন না পারি!..অবশ্য অনেকেরই ডিম্যান্ড এটা..ট্রেণ্ড... মে বি পর্ণ এফেক্ট... উঠি টয়লেটে যাবো...
- এসো...

      ট্রেন বিহারের কোনো গ্রাম দিয়ে যাচ্ছে। কাঁচের বাইরেটা কত রুক্ষ। আসলে পৃথিবীটাই ভীষণ রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুই বড্ড শুষ্ক। চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল জয়ন্ত। বাথরুমের দরজার মধ্যে সুতপা। সভ্য হও মন... পাগলা মনটারে তুই বাঁধ...

No comments:

Post a Comment