'ভক্ত' শব্দটা খুব কানে আসছে। প্রচুর মানুষ ভক্ত বলে নিজেকে
দাবী করছেন। এখন আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে, 'জয় শ্রীরাম' বললেই কি ভক্ত হওয়ার যোগ্য হচ্ছি?
একটু ঘেঁটে দেখি হিন্দুধর্ম কি বলে। হিন্দুধর্ম নিয়েই যখন কথা বলছি তখন একেবারে গীতা
দিয়েই শুরু করা ভালো। কি বলেন? এখন এমন কে আছেন যে বলে বসবে, ওসব গীতা-টীতা আমি মানি
না। তবে গীতায় কি বলে ভক্তের সম্পর্কে? এখন আমি যখন ধর্ম নিয়ে, থুড়ি ভক্তি এবং ভক্ত
নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি, তখন অকারণ যুক্তি, ইতিহাস এই সব নিয়ে কিন্তু মাথা ঘামাচ্ছি
না। তো গীতায় কৃষ্ণ কি বলছেন শোনা যাক। এই 'কৃষ্ণ' কথাটা বলতে গেলেও একটা কথা আছে।
হিন্দুধর্মের ভাগবতে দশাবতারের কথা আছে। অন্যান্য গ্রন্থে অন্য পরিসংখ্যান থাকলেও আমি
বিশেষ করে ভাগবতের কথা বলছি, কারণ ভাগবত হল পুরাণের মধ্যে প্রধান। এই মহাপুরাণকে অনেকে
স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ বলে ধারণা করেন। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন - ভক্ত-ভাগবত-ভগবান,
একে তিন, তিনে এক। অর্থাৎ তত্ত্বমতে এই তিনজনই এক। তো এই ভাগবত পুরাণে কৃষ্ণকেই একমাত্র
বলা হচ্ছে - কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ হলেন স্বয়ং ভগবান।
এবার গীতায় আসা যাক। গীতায় মোট আঠারোটা অধ্যায়।
সেখানে বারো নম্বর অধ্যায় হল ভক্তিযোগ। মহাত্মা গান্ধী ওনার গীতা ব্যাখ্যা এই অধ্যায়
দিয়েই শুরু করেছিলেন। তো গীতায় ভগবান কৃষ্ণ স্বয়ং বলতে চাইছেন ওনার ভক্তের চরিত্র কিরকম
হবে।
অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ
এব চ।
নির্মমো নিরহঙ্কারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী।।১৩।।
সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ।
ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স
মে প্রিয়ঃ।।১৪।।
অনুবাদঃ যিনি সমস্ত জীবের প্রতি দ্বেষশূন্য, বন্ধু-ভাবাপন্ন,
কৃপালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহঙ্কার, সুখে ও দুঃখে সমভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট,
সর্বদা ভক্তিযোগে যুক্ত, সংযত স্বভাব, দৃঢ় সংকল্পযুক্ত এবং যাঁর মন ও বুুদ্ধি সর্বদা
আমাতে অর্পিত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।
যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে
চ যঃ
হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্মুক্তো যঃ স চ
মে প্রিয়ঃ।।১৫।।
অনুবাদঃ যাঁর থেকে কেউ উদ্বেগ প্রাপ্ত হয় না, যিনি কারও দ্বারা
উদ্বেগ প্রাপ্ত হন না এবং যিনি হর্ষ, ক্রোধ, ভয় ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত, তিনি আমার অত্যন্ত
প্রিয়।
অনপেক্ষঃ শুচির্দক্ষ উদাসীনো গতব্যথঃ।
সর্বারন্তপরিত্যাগী যো মদ্ভক্তঃ স
মে প্রিয়ঃ।।১৬।।
অনুবাদঃ যিনি নিরপেক্ষ, শুচি, দক্ষ, উদাসীন, উদ্বেগশূন্য এবং
সমস্ত কর্মের ফলত্যাগী, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।
যো ন হৃষ্যতি ন দ্বেষ্টি ন শোচতি ন
কাঙ্ক্ষতি।
শুভাশুভপরিত্যাগী ভক্তিমান্ যঃ স মে
প্রিয়ঃ।।১৭।।
অনুবাদঃ যিনি প্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে হৃষ্ট হন না এবং অপ্রিয়
বস্তুর প্রাপ্তিতে দ্বেষ করেন না, যিনি প্রিয় বস্তুর বিয়োগে শোক করেন না, অপ্রাপ্ত
ইষ্ট বস্তু আকাঙ্ক্ষা করেন না এবং শুভ ও অশুভ সমস্ত কর্ম পরিত্যাগ করেছেন এবং যিনি
ভক্তিযুক্ত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।
সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে চ তথা মানাপমানয়োঃ।
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু সমঃ সঙ্গবিবর্জিতঃ।।১৮।।
তুল্যনিন্দাস্তুতির্মৌনী সন্তুষ্টো
যেন কেনচিৎ।
অনিকেতঃ স্থিরমতির্ভক্তিমান্মে প্রিয়ো
নরঃ।।১৯।।
অনুবাদঃ যিনি শত্রু ও মিত্রের প্রতি সমবুদ্ধি, যিনি সম্মানে
ও অপরমানে, শীতে ও গরমে, সুখে ও দুঃখে এবং নিন্দা ও স্তুতিতে সম-ভাবাপন্ন, যিনি কুসঙ্গ-বর্জিত,
সংযতবাক্, যৎকিঞ্চিৎ লাভে সন্তুষ্ট, গৃহাসক্তিশূন্য এবং যিনি স্থিরবুদ্ধি ও আমার প্রেমময়ী
সেবায় যুক্ত, সেই রকম ব্যক্তি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
যে তু ধর্মামৃতমিদং যথোক্তং পর্যুপাসতে।
শ্রদ্ধানা মৎপরমা ভক্তাস্তেহতীব মে
প্রিয়াঃ।।২০।।
অনুবাদঃ যাঁরা আমার দ্বারা কথিত এই ধর্মামৃতের উপাসনা করেন,
সেই সকল শ্রদ্ধাবান মৎপরায়ণ ভক্তগণ আমার অত্যন্ত প্রিয়।
এবারে আমরা আসি গীতার পরেই যে গ্রন্থটি
সব চাইতে পড়া হয়, রামচরিতমানস। বাংলায় বইটির প্রভাব না থাকলেও সমগ্র উত্তর ভারতে এর
প্রভাব ভীষণ। সেখান একটা রামগীতা আছে। আমি মূল হিন্দীটাই তুলে দিচ্ছি। সঙ্গে বাংলা
অনুবাদও করে দিচ্ছি। যেখানে রাম স্বয়ং নিজের মুখের নিজের ভক্ত হওয়ার পথ বলে দিচ্ছেন।
कहहु भगति पथ कवन प्रयासा। जोग न मख जप तप उपवासा।
सरल सुभाव न मन कुटिलाई। जथा लाभ संतोष सदाई॥1॥
(বলো তো, ভক্তিপথে পরিশ্রমই বা কি আছে? যেখানে জপ, তপ, যোগ,
যজ্ঞ, উপোস কিছুই লাগে না। শুধু অকপট সরল স্বভাব আর যা পাওয়া যায় তাতেই সর্বদা সন্তুষ্টি।
আর কি চাই?)
मोर दास कहाइ नर आसा। करइ तौ कहहु कहा बिस्वासा॥
बहुत कहउँ का कथा बढ़ाई। एहि आचरन बस्य मैं भाई॥2॥
(তোমাদের কেমন বিশ্বাস বুঝি না, এদিকে আমাকে ভক্তি কর, অথচ
মানুষের সাহায্যের অপেক্ষায় বসে থাকো আমাতে নির্ভর না করে। অনেক কথা বলেছি, আর কি বলি
এই কয়েকটা আচরণেই আমি বশীভূত হই। তুল্য ‘চৈতন্যচরিতামৃত’,
“কৃষ্ণেরে ভক্তি করে, করে লোকাপেক্ষা।
কৃষ্ণ না করেন কৃপা তারে, করেন উপেক্ষা।।”
এখন দেখা যাক কি সেই আচরণসমূহের কথা বলা হচ্ছে---)
बैर न बिग्रह आस न त्रासा। सुखमय ताहि सदा सब आसा॥
अनारंभ अनिकेत अमानी। अनघ अरोष दच्छ बिग्यानी॥3॥
(সে না কারোর কাছে কোনো আশা রাখে, কি শত্রুতা বা ভয় রাখে। তার
সবদিকই সুখময়। সে কোনো কিছুর প্রারম্ভ করে না, গৃহহীন হয়, অমানী হয়। সে পাপহীন, ক্রোধহীন,
দক্ষ ও বিজ্ঞানী হয়।)
प्रीति सदा सज्जन संसर्गा। तृन सम बिषय स्वर्ग अपबर्गा॥
भगति पच्छ हठ नहिं सठताई। दुष्ट तर्क सब दूरि बहाई॥4॥
(সে সব সময় সজ্জনদের সঙ্গে প্রীতি সম্পর্কে যুক্ত। বিষয়াদি,
স্বর্গসুখ, এমনকি মুক্তির ইচ্ছাও যার কাছে তৃণসম তুচ্ছ। ভক্তির দিকে তার অনুরাগ, কিন্তু
অন্যান্য মতের প্রতিও তার শ্রদ্ধা, তাই সবরকম দুষ্টতর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে।)
दोहा -
मम गुन ग्राम नाम रत गत ममता मद मोह।
ता कर सुख सोइ जानइ परानंद संदोह॥46||
(সে সর্বদা আমার নামগুণগানে রত, মোহ, অহংকার, 'আমি ও আমার'
বোধ থেকে মুক্ত। এবং যে পরমানন্দ সুখে মত্ত সেই কেবল জানে সে সুখ কি সুখ। তুল্য রবীন্দ্রনাথ,
“তোমার ধ্যানে, তোমার জ্ঞানে, তব নামে কত মাধুরী, যেই ভকত সেই জানে, তুমি জানাও যারে,
সেই জানে, ওহে তুমি জানাও যারে সেই জানে")
তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা
।
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ
।।
অর্থাৎ, যিনি নিজেকে সকলের পদদলিত তৃণের থেকেও
ক্ষুদ্র বলে মনে করেন, যিনি বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু, যিনি মান শূন্য এবং অন্য সকলকে সম্মান
প্রদর্শন করেন, তিনি সর্বক্ষণ ভগবানের দিব্যনাম
কীর্তনের অধিকারী।
অতএব মহাপ্রভুর শিক্ষা অনুযায়ীও ভক্ত
হতে গেলে রীতিমতো শ্রমের তপস্যা করতে হবে।
আর ইদানীং রামকৃষ্ণের ভাষায় তো ভক্ত
মানে সোনার তরবারি, যা দিয়ে হিংসা করা যায় না।
তবে এই যে ভক্ত বলে ইদানীং যে শব্দটা এসেছে, সে মতে শাস্ত্রপ্রমাণ কিছু আছে? নেই। কারণ এই ভক্তের কথা শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘হিঁদুয়ানি’ আর ভারতের অন্যান্য জায়গায় ‘হিন্দুত্ভা’ চর্চায়। তবে কি 'হিঁদুয়ানি' আর 'হিন্দু' দুটো আলাদা বিষয়? একদম তাই। কেউ কেউ বোকা বলে বুঝতে পারে না। কেউ কেউ বোকা সেজে বুঝতে চায় না। তাই নিজেকে কেউ 'ভক্ত' বললেই আগে জেনে নিতে হবে সে কোন পথের? সনাতন ধর্মের ভক্ত হওয়া যে সোজা কথা নয় সে তো অনেক প্রমাণ দিলাম। কিন্তু ইদানীং মতে ভক্ত হওয়াটা অবিশ্যি খুব একটা কঠিন কাজ নয়। এই পার্থক্যটা মাথায় রাখা ভালো। ভালো হজম হবে। শরীরে মনে পুষ্টি আসবে। জয়গুরু।
No comments:
Post a Comment