বাংলা ভাষায় যে ক'টা ইংরেজি ভাবগত শব্দ ব্যবহার হয়ে থাকে, আমার মনে হয়
তার মধ্যে একটা প্রধান শব্দ হল – 'সিরিয়াস'। 'সিরিয়াসলি বলছি', 'সিরিয়াসলি
কর' ইত্যাদি। যে ক'টা আমাদের পরিভাষা
সিরিয়াস শব্দের আছে – 'গম্ভীর', 'রাশভারি',
'গুরুতর', 'সংকটজনক', 'আন্তরিক'
ইত্যাদি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা যেভাবে বলি ‘সিরিয়াসলি’ বলছি, সেখানে আসলে
আমরা বলতে চাইছি, হালকাভাবে না নেওয়ার জন্য, বা আমি যে মজা করছি না সেটা বোঝানোর জন্য। অথবা কোনো কিছুর গাম্ভীর্যতা
বোঝানোর জন্য। কিন্তু আমি বাংলায় কিভাবে বলতে পারি?- 'তুই
আরো মন দিয়ে পড়', 'তুই আরেকটু মন দিয়ে খোঁজ', 'তুই আরেকটু গুরুত্ব দে ব্যাপারটায়' ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু কোথায় যেন হল না। অর্থাৎ ঠিক সেই অর্থে আমাদের কাছে 'সিরিয়াস'
শব্দটার তেমন কোনো উপযুক্ত পরিভাষা নেই।
আমাদের বাড়িতে যিনি কাজ করেন
তিনি সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ। নিরক্ষর। তাকে আমি যে সকল ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করতে
দেখেছি, তার মধ্যে এই শব্দটা বহুবার শুনেছি, “সিরিয়াসলি বলছি দাদা...", "ওর রোগটা খুব
সিরিয়াস” ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে মনে হতেই পারে যে সে কেন একটা
ইংরাজি শব্দকে নিজের ভাবের কাছাকাছি বোধ করল কোনো বাংলা শব্দ ছাড়া? অবশ্যই শুনে শুনে। তার মানে কি এই দাঁড়াল যে, এই 'সিরিয়াস' শব্দটাকে আমাদের মেজাজের সাথে বা ভাবের
সাথে সেভাবে কোনোদিন পাইনি বলেই হয়ত সেই শব্দটা নেই। সেটা আলোচনার বিষয়টা না হয়
সমাজবিদ ও মনোবিদদের জন্যে থাকুক।
'সিরিয়াস' শব্দটাকে আমাদের একটা প্রতিশব্দের খুব কাছাকাছি ব্যবহার করি আমি দেখেছি,
সেটা হল 'আন্তরিক'। যার
ইংরাজি অর্থ 'সিনসিয়ার'। 'ঐকান্তিক'ও কিছুটা সেই একই গোত্রীয় শব্দ। কিন্তু 'আন্তরিক' বলতে যা বোঝায় 'সিরিয়াস'
বলতে তা বোঝায় কি? আমাদের দৈনন্দিন জীবনের
দিকে দেখি।
আমি দেখেছি আমাদের বাড়ির
মা-জেঠিমারা যে আন্তরিকতার সাথে প্রতিদিন লক্ষ্মীপূজো করেন সেই দিকে। নকুলদানা
অথবা বাতাসা যা হোক হল, একটা নির্দিষ্ট পাঁচালী পাঠ হল
ইত্যাদি। বছরের পর বছর করে চলেছেন কিন্তু মনে কোনো সময়ে কোনো প্রশ্ন আসছে না যে
এটা আমি কি করছি? যে কোনো ধর্মের আনুষ্ঠানিক দিকই তাই হয়।
প্রবল আন্তরিকতার সাথে কাজগুলো করা হয়ে থাকে। এইবার প্রশ্ন হল, তারা কি সিরিয়াসলি কাজগুলো করেন? না। কারণ সিরিয়াস
হলেই মনের মধ্যে নানা সংশয়, নানা প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা মাথা চাড়া
দিয়ে উঠবে। তাই ধর্মে আন্তরিক হওয়ার, অনুগত হওয়ার, প্রশ্নহীন সরল হওয়ার যে প্রশংসা আছে, এর বিপরীতগুলো
হওয়ায় নেই। এমনকি সিরিয়াস হতে গেলেই বলা হবে, তুমি অত কিছু
জানবে কি করে? এত ভেবো না। তুমি এই মন্ত্র সকাল থেকে রাত
অবধি জপে যাও, তোমার কিছু না কিছু হবে। শিষ্য তাই করতে শুরু
করল। বছরের পর বছর সে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সেই কাজ করে চলেছে। এবং নিজের মনের
মধ্যে যে প্রশ্ন, সংশয় ইত্যাদি না এসে একটা শান্তভাব আসছে
তাতে সে নিজেকে ধন্যও মনে করছে। সেই নির্দিষ্ট সময়ে সেই নির্দিষ্ট কাজটা না করতে
পারলে তার যে মনঃপীড়া হচ্ছে তার জন্যেও সে নিজেকে ধন্য মনে করছে কারণ সে একটা পথে
নিজেকে সম্পূর্ণ বশীভূত করতে পেরেছে। কিন্তু সে কিছুতেই বুঝবে না যে সে আসলে
নিজেকে মেরে ফেলছে শান্তির শীতল কারাগারে। অত সোজা পথে শান্তি মেলে না। যেমন গাড়ির
চাকা না থাকলে গাড়ি কোনোদিন চলে না, অতএব কোনো দুর্ঘটনাও ঘটে
না। এও সেই স্থবিরতার নিরাপত্তা। অবোধের শান্তি।
কিন্তু সে যদি সিরিয়াস হয়ে
পড়ে, সে প্রশ্ন করবে। সে অস্থির হবে। কারণ আমি দেখেছি সেই
অতিভক্ত মানুষই যখন ব্যাঙ্কে যাচ্ছে তখন আন্তরিক হয়ে সবার কথা না শুনে প্রতি
পদক্ষেপে অত্যন্ত সিরিয়াস হয়ে প্রতিটা জিনিস বুঝে বুঝে কাজ করছে। প্রশ্ন করছে। বরং
অন্যের থেকে বেশিই প্রশ্ন করছে। অবাক লাগে একই মানুষ এমনভাবে নিজেকে বদলে নেয় কি
করে? একই মানুষ নিজের প্রত্যক্ষ স্বার্থের বেলায় যেমন
সিরিয়াস, তেমনই পরকালের বা দৈবের কৃপা পাওয়ার জন্য নির্বোধের
মত আচরণ করে কি করে? সে জানে ব্যাঙ্কের টাকার হিসাবে গরমিল
হলে কোনো আষাঢ়ে গল্পেই মনকে প্রবোধ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সে এক্ষেত্রে সিরিয়াস
হওয়াকে, সিনসিয়ার হওয়ার থেকে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার
কাছে।
আদতে যা কিছু সিরিয়াস তার
থেকে আমাদের বাঙালী সমাজের একটা বৌদ্ধিক বিচ্ছেদ ঘটছে। এ রোগের কথা বিবেকানন্দ ও
নেতাজী বলেছেন, তাদের লেখায় পড়েছি। দু'জনেই
বলছেন, আমাদের রক্তে গুরুগম্ভীর জিনিস “হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া” একটা রোগ হয়েছে। এই কথাটা
আমাদের ভাববার। অবশ্যই বাঙালীর সমালোচনায় সাধারণ বাঙালীর কাছে চন্দ্রিল যেভাবে
আবেদন রাখবেন সেভাবে নীরদচন্দ্র চৌধুরী বা অম্লান দত্ত আবেদন রাখবেন না। কারণ আমরা
সিরিয়াস আলোচনার চাইতেও রসালো আলোচনায় বেশি আগ্রহী। আগ্রহী অন্য ভাষায় 'আন্তরিক'। সমস্ত রসটা চেটেপুটে নেওয়ার জন্য প্রবল
তাগিদ আমাদের। বাকি যে দু'জনের কথা বললাম তা পড়তে গেলে
ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস হয়ে পড়তে হয়, ভাবতে হয়। কারণ 'সিরিয়াস' শব্দটার সাথে ভাবনা-চিন্তার একটা যোগাযোগ
তো আছেই। কেন ভাবব। আমার অন্তর তো সুখ চায়, শান্তি চায়,
নিশ্চয়তা চায়, আমোদ চায়, তাই সেইতেই আমি আন্তরিক। রবি ঠাকুরের গান বলো পড়ছি, প্রবন্ধ
কেন পড়ব রে বাবা?
এখানে আরো একটা দিক আলোচনায়
এনে আমি ইতি টানি। সাহিত্যের ক্ষেত্রে, ও অভিনয়ের ক্ষেত্রে।
আর যে কোনো কাজে মানুষকে ভদ্রসভ্য হওয়াটা বাঞ্ছনীয় হলেও, লেখা
আর অভিনয় এমন দুটো কাজের ক্ষেত্র যেখানে জীবনকে সিরিয়াসলি নিতে হয়, নীতি বা অন্য কোন কিছুকে নয়। তাই তাকে বাইরের জীবনে দুষ্টুলোক না হলেও
মনের মধ্যে দুষ্টুলোককে দুষ্টু বলে তাড়িয়ে দিলে চলে না, তার
প্রধান দায় সত্যের কাছে। সে সত্য ভাবগত ও বস্তুগত --- উভয়ক্ষেত্রেই। তবু ভাবগত
সত্যের আবেদন তার কাছে বেশি। তাই মার্কেজের গ্রামের ভৌগলিক অস্তিত্ব না পেলেও
ভাবের জগতে তার ম্যাপ খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। এখানেও আমরা কিছু কিছু জায়গায়
পিছিয়ে। একটা কাহিনী মানুষের ব্যবহার আর তার চিন্তা অনুভবের বিবরণ – এই দুইয়ের একটি ধারা প্রধানত। প্রেক্ষাপটে অনেক কিছু থাকলেও তা নেপথ্যেই।
কিছু কাহিনীতে প্রথম ধারাটি বেশি; কিছুতে কাহিনীতে
দ্বিতীয়টির পরিমাণ বেশি। মানুষ জটিলতম জীব। ভাষা একটি দুর্বল উপায় মানুষের সে
রহস্য উন্মোচনের চেষ্টায়। ধর্ম একটা বিশেষ দিকে মানুষকে টানে। রুচি, শালীনতা, সংস্কৃতি আরেকদিকে। এ সবের মধ্যে থেকে আসল
মানুষটির নাগাল মেলা শক্ত। রুচি, শালীনতা, সংস্কৃতির বিপরীতে কিছু একটাকে লিখে ফেললেই যেমন মানুষের নগ্নরূপ ধরা হয়
না, সেটা ভীষণ বস্তুগত নগ্নতার কথা হয়ে যায়, তেমন কোনো মানুষের পোশাকহীন স্ক্যান রিপোর্ট অথবা তার গোপন জীবনের
খুঁটিনাটি, অথবা তার বিকারগ্রস্থ মানসিকতার বিবরণও কিন্তু
সাহসী লেখা বা অকপট লেখা হয়ে যায় না। সব চাইতে কঠিন জায়গা হল মানুষের id-ego-superego-র টানাপোড়েনে দাঁড়ানো মানুষটাকে ভাষা কতটা উন্মোচিত করতে পারল তার উপর।
বাকি ঘটনার পর ঘটনার বিবৃতি, ফেনার পর ফেনা জমিয়ে যা গড়ে ওঠে
তার হয়ত একটাই আবেদন – সুখপাঠ্যতা। সেই সুখপাঠ্য সাহিত্যের
চাহিদাও যেমন বেশি, পাঠক যেমন বেশি, তার
মূল্যও কম কিছু নয়। কিন্তু এর বিপরীতে আরেক জাতের সাহিত্য আছে। একটা খোঁজের
সাহিত্য। সে সাহিত্য সেই টানাপোড়েনের রঙটা যতটা স্পষ্ট পারে আঁকতে চায়। তার পাঠক
কম। তার চাহিদা কম। যা অবশ্যই যে কোনো ভাষাতেই দুর্লভ ‘কঠিন
বই’-এর আখ্যা পেয়ে যায়। আলোচনা কম হয়। কারণ তাতে রস অত্যন্ত
গহীন। তার পাঠকেরা সিরিয়াস পাঠকের তকমা পান। চলতি কথায় আঁতেল। কথাটা সত্যিই। যা
কিছু সিরিয়াস – তা খানিক রসহীন, খানিক
অনিশ্চিত সংশয়াপন্ন, খানিক বিষাদময়। রবীন্দ্রনাথ যে শেষ
জীবনে – ‘সত্য যে কঠিন’ বলেছিলেন,
সে সত্যের এই স্বভাবের জন্যেই বোধ করি। সত্য সিরিয়াস, আন্তরিক নয়, আন্তরিক তো গল্প। কিন্তু সেই যেন শেষ
আশ্রয়।
No comments:
Post a Comment